দীর্ঘদিন করোনা বিপর্যয়ে আছি সবাই। ঘরে থাকা শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যন্ত সবাই জানেন শিক্ষার সংকটের কথা। প্রথমে সবাই ভেবেছিলেন-কয়েক দিনে করোনা চলে যাবে। শিক্ষার পরিকল্পনাও তখন সেভাবেই হয়েছিল।

এখন দেখা যাচ্ছে, করোনাকাল কেবলই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারের অংশীজন সকলেই একমত-যে এই মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব নয়। পৃথিবীর প্রধান প্রধান দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা বলতে পারি, দুটো সিদ্ধান্ত মূলত অনুসরণ করছে সবাই।

এক, শিক্ষপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে পাঠদান চালিয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া বা না হওয়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ইচ্ছে। দ্বিতীয় পথ হলো-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান  বন্ধ রেখে কীভাবে পাঠদান শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়। দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সম্ভবনার জায়গা, একইসঙ্গে বড় চ্যালেঞ্জও। আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থায় আগে থেকেই নানা বৈষম্য ছিল, করোনাকালে সে বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। ডিজিটাল শিক্ষা সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা ও সচ্ছল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোনো রকমে চালিয়ে নিচ্ছে। অন্যদের চিত্র ঠিক বিপরীত। আমাদের দেশে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরি করা হয়েছিল। অথচ করোনাকালে আমরা তার সুফল পাচ্ছি না।

শিক্ষায় করোনার ক্ষতি কাটাতে গেলে প্রথমে আমাদের সঠিক তথ্য-উপাত্ত দরকার। প্রশাসনিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তা হবে না। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে তথ্য এনে নানা সরকারি দপ্তর ঘুরে সে উপাত্ত তৈরি হয়, এমন প্রশাসনিক তথ্য নিয়ে ইউনেস্কোরও উদ্বেগ রয়েছে। তাই খানা জরিপ দরকার। শিক্ষা নিয়ে সরকারের নানা উদ্যোগের তথ্য বহু শিক্ষার্থীর কাছে নেই, যেমন আবার বহু শিক্ষার্থীর তথ্য সরকারের কাছে নেই। ডিজিটাল শিক্ষা বিষয়ে বহু শিক্ষার্থী পিছিয়ে। অনেকের বাবা- মায়েরাও লেখাপড়া জানেন না। তাদের সাহায্য দিতে যে পদ্ধতি দরকার ছিল, তা সরকারের নেই। এসব কাজ এনজিওনির্ভর। অথচ করোনা কালে শিক্ষাসংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম না চালাতে এনজিওদের বলা হয়েছে।

করোনায় শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ মুহুর্তে প্রয়োজন হোম বেউজড ডিজিটাল লার্নিং জোরদার করা। তা করতে গেলে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন হবে একটি ডিজিটাল ডিভাইস, ইন্টারনেট সংযোগ, ডাটা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ সরকারকে দিতে হবে। তবে ডিজিটাল ডিভাইস আর ডাটা দেওয়ার ব্যবস্থা বেসরকারি খাত থেকেও হতে পারে। করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) এর আওতায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে না হোক, প্রত্যেক পরিবারকে অন্তত একটা ডিভাইস দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা এগিয়ে আসতে পারে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরসহ সবমিলিয়ে আমাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি। সরকারের কাছে উপবৃত্তি বিতরণের মডেল রয়েছে। সেই মডেল ব্যাবহার করে শিক্ষার্থীদের হাতে ডিভাইস পৌঁছানো সম্ভব। উপবৃত্তি যেমন কিছু শর্তসাপেক্ষে দেওয়া হয়- ৪৫ দিন ক্লাসে উপস্থিতি, ৮০ শতাংশ পাস করতে হবে- এমন কিছু শর্ত প্রয়োজনে ডিভাইস দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। মূল কথা হলো, ক্ষতি পোষাতে সবক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অসচ্ছল পরিবারের তালিকা করে অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিতে হবে। মোদ্দা কথা, হোম বেইজড ডিজিটাল লানিং জোরদার করতে যা করা দরকার তা সরকারকে করতে হবে।

এরপরে আসে ডিভাইস ব্যাবহারের সক্ষমতা অর্জন। দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক পরিবারের অভিবাবক ও সন্তানদের এই পাঠদানে অভ্যস্ত করে তুলতে ও তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পাড়াভিত্তিক একজন করে শিক্ষক নিযুক্ত করা যায়। গ্রামের কয়েকটি বাড়ি মিলে একটা পাড়া, সেখানে হয়তো শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০০ জনের ওপরে হবে না। শিক্ষক তার বাড়িতে বসেই যুক্ত হবেন এই শিক্ষার্থীদের সংগে। ঘণ্টা ও সময় ভাগ করে ক্লাস চলবে। পাড়াভিত্তিক মাসিক সূচিও তৈরি করা যেতে পারে এর জন্য ।

সব শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে টিকা দিতে হবে। শিক্ষকদের প্রণোদনা দিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থীকে শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে সরকারের শক্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। আমাদের দু:খের একটি বিষয় হলো-এখানে সব সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয়ভাবে হয়। শিক্ষার বড় অংশীজন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। তাদের অভিমত জানার চেষ্টা করা হয় না। তাই অনেক সিদ্ধান্তে গ্যাপ থেকে যায়। শিক্ষা কারো একার বিষয় নয়। শিক্ষা পুরো জাতির মেরুদন্ড। সবাইকে তা ভাবতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো-আমরা এভাবে ভাবছি কিনা। সরকারের অগ্রাধিকারের জায়গায় শিক্ষাকে আনতে হবে। এ মুহূর্তে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। এমন হলে, শিক্ষা থেকে আমরা আমাদের একটি প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলবো। যে ক্ষতি আর কখনো পূরণ হবার নয়।

লেখক : রাশেদা কে. চৌধুরী : গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। কৃতজ্ঞতা : কলম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে