অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপে প্রথম শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হয়। এর প্রায় এক শতব্দী পরে ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ঘটে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হয় বিংশ শতকের শেষার্ধে। ১৭৮৪ সালে স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার,১৮৭০ সালে বিদুৎ আবিষ্কার এবং ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার ছিল তিনটি শিল্পবিপ্লবের প্রধান অনুঘটক। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০০ বছর পরপর শিল্পবিপ্লবের ঘটনাগুলো ঘটেছে। সে হিসেবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটার সম্ভাব্য সময় একবিংশ শতকের শেষার্ধ। কিন্তু তথ্য প্রবাহ, সফট ইন্টেলিজেন্স এবং এতদসংক্রান্ত সফট প্রযুক্তি এত দ্রুততার সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে যে, এই বিপ্লবের জন্য আর ১০০ বছর অপেক্ষার প্রয়োজন হবে না। আগামী এক-দুই দশকের মধ্যেই  শিল্প বিকাশের এই বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে। এটিকে বলা হচ্ছে ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’। অন্যান্য শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পার্থক্য হলো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লব শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক প্ররিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শারীরিকের সঙ্গে মানসিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করবে’।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হলো শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে অতি উচ্চমানের সফ্ট ও হার্ড প্রযুক্তির ব্যবহার, যা দ্রুত ও অধিকতর অর্থনৈতিক বিকাশের সহায়ক। ২০১১  সালে জার্মান সরকরের উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশলের একটি প্রকল্প থেকে আসন্ন শিল্পবিপ্লবের এই ঘটনাটি ‘ইন্ডাস্টি ৪.০’ নামে উল্লিখিত হয়। ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ শব্দটি উল্লেখ করেন। এই ধারনার প্রধান বিষয় যান্ত্রিক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগান্তকারি অগ্রগতি; যথা: সেলফ্-অপটিমাইজেশন, সেলপ-ডায়গনসিস, সেলফ-কনফিগারেশন প্রভৃতি। ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংস এই বিপ্লবে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রাখবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। তথ্য সৃজন ও বিতরণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ এবং ইন্টারনেটের সমন্বিত ব্যবহারে সমগ্র বিশ্বে এই বিপ্লব এক বিপুল পরিবর্তন আনতে চলেছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও দ্রুত পরিবর্তিত হবে, আর্থিক শক্তিকেন্দ্র পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। ফলে বাংলাদেশেরও এক্ষেত্রে রয়েছে যথেষ্ট সম্ভাবনা। ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে পরিনত হওয়ার যে রূপকল্প নির্ধারন করা হয়েছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। এর জন্য সুচিন্তিতভাবে করণীয়সমূহ নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যার লক্ষ্য হবে উচ্চতর ও আধুনিক মানের দক্ষতার উন্নয়ন।

ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে উন্নতির জন্য অপরিহার্য ১০টি দক্ষতার উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো- জটিল সমস্যার সমাধান, বিশ্লেষণী চিন্তা, সৃজনশীলতা, মানব ব্যবস্থাপনা, অন্যের সঙ্গে সমন্বয়, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সেবা অভিযোজন, আলাপ-আলেচনা এবং জ্ঞানীয় নম্রতা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম ও আইএলও-এর যৌথ সমীক্ষায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের জন্য করণীয়ের ৬টি ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়। এগুলো হলো : সনাতনী শিক্ষা পদ্ধতির রূপান্তর, অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্ভাবন, গবেষণা, সরকারি নীতিমালার সহজীকরণ, প্রবাসী বাংলাদেশিদের দক্ষতা কাজে লাগানো এবং রাষ্ট্রীয় ব্র্যান্ডিং। অর্থাৎ আসন্ন শিল্পবিপ্লবের সুফল অনুঘটক হতে গেলে ব্যাষ্টিক ও সমষ্টিক মেধার সমন্বিত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সন্দেহ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়  পর্যায়ের শিক্ষা এক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ ইতিমধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য তাদের বহুমুখী প্রস্তুতি শুরু করেছে। এই প্রস্তুতির প্রধান অংশ মূলত উচ্চতর প্রযুক্তি, জ্ঞান ও গবেষণা সংক্রান্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে এ ব্যাপারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২০২১ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব–সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। ১০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে উক্ত সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী সৃষ্টি ও পরিবেশ সংরক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এই বিপ্লবের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। কিছু নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। মেশিন মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে, সস্তা শ্রমিকের চাহিদা কমে যাবে, অসমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অভিবাসনকে উৎসাহিত করবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে ও প্রযুক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে।’

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো-সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে   দুটি  সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত, ২০২৩ সাল নাগাদ তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে সংযোগ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের একটি অন্যতম স্লোগান হলো-ডিজিটাল বাংলাদেশ। এটি মূলত ডিজিটাইজেশনের একটি প্রক্রিয়া। সন্দেহ নেই, এই প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী একটি রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের কারণে শিল্পবিপ্লবের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি অনেকখানি সম্পন্ন হয়ে আছে। এখন তথ্য ও  বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির উচ্চতর বৈশ্বিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশ সহজ হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটিরও বেশি। গত ১২ বছরে দেশে অন্তত ৩৯টি হাইটেক পার্ক নির্মিত হয়েছে, যার মধ্যে ৯টি পার্কে ইতিমধ্যে ১৬৬টি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে দেশে ৮ হাজারের বেশি ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় তথ্য বাতায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এই তথ্য বাতায়ন বাংলাদেশের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের সব কার্যক্রম ও সেবা এক প্ল্যাটফরমে এনে দিয়েছে। ৫২ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট এই বাতায়নের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে রয়েছে ৯৫ লাখের অধিক বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট, ৬৮৫টির বেশি ই-সেবা। বেসরকারি খাতেও ডিজিটাইজেশনের বিপুল বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ফান্ড ট্রান্সফার, অনলাইন সভা-সেমিনার ও শিক্ষা, বিল পরিশোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার অনলাইনভিক্তিক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এখন প্রয়োজন বিদ্যমান এই অগ্রগতিতে আরো গতিশীল করা এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে গবেষণা, উদ্ভাবন ও জ্ঞান বিতরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যে কর্মসূচি নিয়েছেন, তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অনুঘটকের ভূমিকা নিতে পারে। এজন্য সেগুলোর মিশন ও ভিশন হতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী; পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও প্রয়োজনীয় সুবিধাদি পেলে এগুলো নিশ্চিতভাবেই আসন্ন শিল্পবিপ্লবের প্রধান সহায়কে পরিণত হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতির দ্রুত ও গুণগত সম্প্রসারণ এক্ষেত্রে অনুপূরক ভূমিকা পালন করবে। বর্তমান বাংলাদেশে বিদ্যমান দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের কারিকুলাম ও অবকাঠামোর যাথাযথ উন্নয়নের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অভিযাত্রায় সামিল হতে পারে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক্রম ও পাঠক্রম আধুনিক এবং প্রয়োগোপযোগী করতে হবে। এজন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সম্ভাব্য কোন ধরনের গ্র্যাজুয়েট ও গবেষক প্রয়োজন হবে, তার যথাযথ সমীক্ষা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাথীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় ও মুখস্থ অংশের চেয়ে ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক অংশের উপর বেশি গ্রেডিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে দেশ-বিদেশের হাইটেক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মী সরবরাহের সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে উপযুক্ত হাইটেক ল্যাব সুবিধা সম্প্রসারণ এবং আধুনিক গবেষণা সরঞ্জামাদির সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আসন্ন শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়ক হবে। এসব যত দ্রুত করা সম্ভব হবে, তত দ্রুত বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অনুঘটকে পরিণত হতে পারবে।

লেখক : প্রফেসর ড. মো. দিদার-উল-আলম, উপাচার্য, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

কৃতজ্ঞতা : ইরাব।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে