বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আবর্তন করে। যৌবনের শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে আমৃত্যু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ৬ দফা, ৬৯-এর গনঅভ্যুথান, ৭০- এর নির্বাচন, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দেলননের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন এর বাহক, অনুঘটক, নেতা ও পুরোধা ব্যাক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুর এসব গুণের উৎপত্তিস্থল বা এর জন্য যে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন ছিল সে চেতনার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে লালিত ও উত্থিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, গণতান্ত্রিক চেতনার মতো এই মুল্যবোধীয় জায়গাগুলোকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায়  সংশ্লেষণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। সেই জন্য বলা হয়, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একই সূত্রে গাথাঁ। একটি অন্যটির পরিপূরক।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনায়ও এই পটভূমির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকশিত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখতেন একটি গণতান্ত্রিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাঁর চিন্তা ছিল শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হবে শিক্ষক দ্বারা। সেই কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি যতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যেমন, প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিব শিক্ষকদের মধ্য থেকে নির্বাচন করলেন; শিক্ষা কমিশন গঠন করলেন শিক্ষক দিয়ে; কারণ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয় শিক্ষকরাই ভালো বোঝেন। ৩৬ হাজারের অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়কে  জাতীয়করণ করলেন, যা ছিল একটি জনগোষ্ঠীর উত্থানের প্রাথমিক ভিত। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল গণমুখী, সার্বজনীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা। মূলধারার বাইরে কারিগরি ও ধর্মীয়সহ শিক্ষার অন্যান্য শাখাগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতেন বঙ্গবন্ধু।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মর্যাদা ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন ‘১৯৭৩ আদেশ’-সহ যে বিরল সুযোগ-সুবিধা তাঁর alma mater-কে প্রদান করেছেন তা, নিঃসন্দেহ, `Unparallel Monumental Royal Reward’। এ আদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে দর্শর ফুটে ওঠে তাহলো-বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্তিচিন্তার জায়গা। যেখানে একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায্যভিত্তিক পরিবেশ থাকবে। ফলে মুক্ত মনে শিক্ষক-শিক্ষর্থীরা জ্ঞানচর্চা করতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় আমলাতান্ত্রিক প্রভাব মুক্ত হবে যেন কোথাও কারো কাজ আটকে না যায় এবং নানাবিধ শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত না ঘটে।

গত পাচঁ দশকে দেশের উচ্চশিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা সবগুলোরই প্রাসার ঘটেছে, তবে এই সম্প্রসারণটি পিরামিড আকারে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে পিরামিডের বদলে সমান্তরাল রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ধাপটি বেশ হরাইজন্টাল রূপ নিয়েছে। প্রসারণের পর এখন আমাদের শিক্ষার গুণগত মানে জোর দিতে হবে। শিক্ষার কিছু প্রায়োগিকতা লাগবে। এখন আমাদের সেদিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। বাস্তবধর্মী, দক্ষতাভিত্তিক ও প্রায়োগিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে আদর্শিক ও মূল্যবোধীয় গুণাবলী থাকতে হবে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের যুগে এটা নিয়ে কেউ না ভাবলেও চুতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে এ ভাবনা জরুরি। বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন চ্যলেঞ্জ মোকাবেলায় প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর কৌশল ও যোগ্যতা অর্জন করা খুবই প্রয়োজন। আমরা ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। যার  নাম দেওয়া হয়েছে- ‘গ্র্যাজুয়েট প্রমোশন অ্যান্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট’। এর আওতায় গ্র্যাজুয়েটদের ভাষাদক্ষতা, কর্পোরেট শিষ্টাচারসহ প্রায়োগিক ও বাস্তবধর্মী বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সর্বোপরি প্রতিযোগিতার বিশ্বে নিজেদের সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করে গড়ে তোলা হবে।

লেখক: অধ্যাপক ড. মো আখতারুজ্জামান : উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কৃতজ্ঞতা : কলম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে