আদেশ-অধ্যাদেশ-বিধান অনুযায়ী দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপচার্যর মেয়াদকাল চার বছর বলা হয়েছে। প্রধান চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের আলোচনার পর সিনেটের প্রস্তাবনা শেষে তিন জনের নামের সংক্ষিপ্ত তালিকারূপে শিক্ষামন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির দরবারে যাবার প্রক্রিয়াতেই বিধিবদ্ধ। কিন্ত এ বিধান এই ৫০ বছরের বাংলাদেশে, দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকে যাত্রা শুরু করা চারটি প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা , রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরে কখনো অথবা মাত্র কতবার পালিত হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা, গবেষণা ও অনুপ্রেরণার তত্ত্ব খোঁজা প্রয়োজন। গত ২৫ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো সিনেট বসেনি যা উপাচার্যর সংক্ষিপ্ত তালিকা নির্বাচনের গৌরব ধারণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনির্বাচিত ভিসিরা যুগ যুগ ধরে এডহক ভিত্তিকে কে কার চেয়ে কত শত বেশি নিয়োগ দিতে পারেন সেই প্রতিযোগিতা করে গেলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির শিকার হয়ে মাসের পর মাস বন্ধ থাকে ক্যাম্পাস যেখানে শীতের পাখিরা এসে পায় না শিক্ষার্থীদের।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চার বছরে এক জনের বদলে একবছরেই চার জন উপাচার্য পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম। ব্যাক্তিগত জীবনে বোধের ক্ষয়লাভের ঘটনা নিত্যকার ও ভুলে যাওয়ায় অভ্যস্ত হলেও দেশের সবচেয়ে প্রধান একসময় যাকে প্রাচ্যর অক্সফোর্ড বলেও ডাকার চেষ্টা করা হয়েছিল সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনেই খুজঁলে আপনি এটা পেয়ে যাবেন। এক বছরেই ৪ জন বলে পাঠক যদি ভাবেন এটা বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে তবে তা উপাচার্যর তালিকা লেখা থাকা নথির জন্য অপমানজনক হয়ে উঠবে। ২০০১- এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্রিটিশ আমলের ১৮৭২ জেনারেল ক্লজেজ এ্যক্ট দিয়ে ১১ নভেম্বর সরানো হলো উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীকে। রাতের বেলা নতুন নিয়োগের আদেশে নিয়ে প্রশাসনিক ভবনে চলে এলেন অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। দেখা গেলো নির্দেশমতো আগেই বাকি কাজ শেষ করে প্রস্তুত ছিলেন রেজিস্ট্রার মো. সেলিম। শামসুন্নাহার হলে ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় কালো অধ্যায় সংযোজিত হলো ঢাবিতে। আন্দোলনের মুখে ২০০২-এর ৩১ জুলাই পদ ছাড়লেন আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। ভারপ্রাপ্ত ভিসি হলেন অধ্যাপক আ ফ ম ইউসুফ হায়দার । তাকে ভারমুক্ত করে ২০০২- এর ৯ সেপ্টেম্বর নতুন উপাচার্য হলেন জনপ্রিয় অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ । তা কী হলো । কেনো হলো। এক বছরেরও কম সময়ে মাত্র ১০ মাসে চার জন উপাচার্য দেখলাম আমরা।
কারণ সরকার বদলালে যতই স্বায়ত্তশাসিত বলা হোক, লেখা হোক তা আর থাকে না । যতই কঠিন কঠিন বিধি লেখা থাকুক সেই বিধির পাশ দিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে নীল থেকে সাদা অথবা সাদা থেকে নীল হয় সিন্ডিকেট, সিনেট। যতই নির্বাচিত রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট আর শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের কঠিন কঠিন বিধি থাকুক, সেই ভোট যা গোপনেই হয়, তাতেও কিছু ঠেকে থাকে না, মাথা যায় যেদিকে লেজও সেই পথেই দৌড়ে পথ খোঁজে। এসবের বিপরীতে দীর্ঘ সময় জুড়ে টিকে থাকলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। তাদের হুংকারটা কাজে লাগতো দেশের নানান ঘাত প্রতিঘাতে। কিন্ত দেখা গেলো সেই সমিতির একটা বিবৃতি একটা অবস্থান যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ তাই তার সদস্য হবেন যারা শিক্ষক তাদের সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকলো ক্লাসে পড়ানোর যোগ্যতা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মর্যাদা বাড়ানোর প্রচেষ্টার বদলে। এখনো কানে বাজে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের কথাটা। কী স্পষ্ট, কী নির্বিকারভাবে তারা বললেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নয়, ভোটার নিয়োগ দেয়া হয়। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না। প্রশাসন বা শিক্ষক সমিতি। আমার সে সময়ের রিপোর্টিং তাই আরো সাহস পেলো। মনে পড়ে খুঁজেছিলাম আসলেই তারা শিক্ষক না, ভোটার। সম্প্রতি সেই ভোটারের একজন দেশের একটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছেন। কিন্ত তিনি বা তারা কিন্ত খুব সোচ্চার। সোচ্চার কেনো? সোচ্চার এই জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশে শিক্ষকদের রাজনীতি করার স্বাধীনতা দিয়েছে , স্বায়ত্তশাসনও দিয়েছে। আর সেই স্বায়ত্তশাসন এখন রূপ নিয়েছে স্বেচ্ছাচারিতায়।
কেমন স্বেচ্ছাচারিতা। মাত্র ১০ বছর আগেও এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা উপাচার্য হতেন তাদের শিক্ষাজীবনের বেচেঁ থাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষককে পেতে বেগ পেতে হতো। কেউ তা না পেলে বড় জোড় কলেজের শিক্ষককে পেতেন। তাকে সালাম করে আশীর্বাদ নিতেন যেনো একটি সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালনে তিনি সফল হন।
এখন মাত্র ১০ বছর পরে বিশ্বিবিদ্যালয় ও কলেজের প্রবীণ শিক্ষকদের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনের কর্মচারী ও বয়ষ্ক কর্মকর্তাদের পরিচালনার জন্য এমন প্রধান নির্বাহীর অনুমোদন দেয়া হয়, যার সব আছে। কী সেই সব। আপনি চাইলেই খুজেঁ পাবেন সেই ভিসির প্রাথমিক স্কুলের অর্ধেক স্যার,মাধ্যমিকেরও অর্ধেক, কলেজের শতকরা ৮০ ভাগ আর বিশ্ববিদ্যালয়েরও তাই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেমন অভিজ্ঞতার দাম না দিয়ে ছাটাই চলে, তেমনি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের দীর্ঘতর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটানো হচ্ছে।
তার মানে কী? ১৯৮৪ সালের ২ জুনের সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হবার পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৪ শর্তের প্রথমটিতে টানা ২৫ বছর শিক্ষকতা করার কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে ১০ বছর সহযোগী অধ্যাপক থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রভাষক থেকে সহকারী, সহকারী থেকে সহযোগী বিধানও এমনই কড়া। তো উপাচার্য তাহলে কে হতে পারেন, ভাবুন।
কী গবেষনা, কী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো প্রশাসনিক পদের অভিজ্ঞতা, নিদেনপক্ষে শিক্ষক সমিতির লিডারশীপে থাকা কোনো কিছুই আর লাগে না। তো কী লাগে। এমফিল লাগে না, পিএইচডি লাগে না, স্বীকৃত র্জানালে প্রবন্ধ প্রকাশ লাগে না। লাগে শুধুই দাসত্বের শতভাগ মনোবৃত্তি। যার দাসত্ব দেখে বিগলিত হওয়া যায়, ভরসা পাওয়া যায়, সে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেই চলবে, তা সে কীভাবে শিক্ষক, কেনো শিক্ষক, তাও আর বিবেচ্য নয়। প্রধান অনেক বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, যেটি পুরো মাত্রায় এক রাজনৈতিক পদবীর মতো অভিযোগ নিয়ে দাড়িয়েছে, এখন এমন যে তার বন্ধুরা ক্যাম্পসের আড্ডার জায়গাগুলোতে বসে তার উপাচার্য বন্ধুদের নানা কাহিনি নিয়ে হাস্যরস করে সময় কাটান। এই তো আগালাম।
আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো সরাসরি মালিকের পছন্দ। যেখানকার যে মালিক সেখানকার তার মনের মতো উপাচার্য। সে কে, সে কেমন, সে কেমন হবে, এসব প্রশ্ন এখন মনে আনাও বারণ। এটাই কী তবে উচ্চশিক্ষায় অগ্রগতির স্মারক?
লেখক : বোরহানুল হক সম্রাট : বার্তা সম্পাদক, নিউজ টোয়েন্টিফোর। শিক্ষাবিটের সাবেক প্রতিবেদক। কৃতজ্ঞতা : কলম।