বিশ্বব্রম্মাণ্ডে যা কিছু ছিল ও আছে সে সম্পর্কে বিদ্যাদান, বিদ্যাগ্রহণ, জ্ঞানের অনুসন্ধান, নিরন্তর গবেষণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-অধিবিদ্যা ইত্যাদির চর্চা-অনুশীলনের ক্ষেত্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়। দেশ ও মানবতার কল্যাণে শিক্ষা ও গবেষণায় উৎকর্ষ সাধনই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য।
মূলত: বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানসৃষ্টির সর্বোচ্চ তীর্থস্থান, যার জন্য প্রয়োজন গবেষণা। তাই কবিগুরু যথার্থই বণেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান হচ্ছে গৌণ; কিন্ত জ্ঞান সৃষ্টি ও উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা মূখ্য।”একটি দেশ কত বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। এ ধারণা থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেন। যে উদ্দেশ্যে এ স্বায়ত্তশাসন তা কতটুকু আমরা সদ্ব্যবহার করেছি; আর কতটুকু অপব্যবহার করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করলে এর উত্তর খুঁজে পাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুক্ত বুদ্ধির চর্চা করবে; জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিত্যনতুন দিক নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি করবে; পুরানো বিষয় নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করবে; প্রচলিত ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করবে ও নতুন উত্তর অন্বেষণ করবে। অতপর সৃজনকৃত জ্ঞান ও পরিবর্তিত ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ এবং সমাজের কল্যাণে উক্ত গবেষণালব্ধ ফলাফলকে ব্যবহার করে দেশের অগ্রযাত্রা আরো বেগবান করতে পারে।
বর্তমান সরকারের সময় বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৭৪; জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন -২০১০ এবং রিও ২০+ সম্মেলনে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে উচ্চশিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন সম্প্রসারণ ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার স্ট্রাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন: ২০১৮-২০৩০ অনুমোদন দিয়েছে এবং সে মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (বিমক) কাজ করে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে সরকার মানসম্মত শিক্ষা প্রযুক্তি ও গবেষণার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব বা জোর দিচ্ছে । ২০০৯-১০ অর্থ বছরে বিমক ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ১.৫৭ কোটি এবং ৬.১৪ কোটি টাকা যা ২০২১-২২ অর্থ বছরে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৮ কোটি এবং ১০০ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা অর্থাৎ গবেষণা খাতে বরাদ্দ বিগত এক দশকে যথাক্রমে ১৬.৪৩ কোটি এবং ৯৪.৬০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার শতকরা হার যথাক্রমে ১০৪৬% ও ১৫২৪%।
এটা সত্য যে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার যোগাযোগ ও সহযোগিতা আশাব্যঞ্জক নয়। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিল্প কারখানার সমস্যাদি নিয়ে যৌথ গবেষণা প্রয়োজন। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জানাবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা তা গবেষণার মাধ্যমে সমাধান করে দেবেন। এর বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গবেষণার জন্য অর্থ পাবে। আর শিল্প প্রতিষ্ঠান তার সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে পণ্যের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যতা আনয়ন করতে সক্ষম হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটা স্বাবলম্বী হয়ে রাষ্ট্রের রাজস্ব বাজেটের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেদের বাজেট নিজেরাই প্রণয়ন করতে সক্ষম হবে। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তথা সম্মানিত উপাচার্য মহোদয়কে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণাকে সম্প্রসারণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এখনো পর্যন্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পরিচালিত অধিকাংশ গবেষণা তাত্ত্বিক প্রকৃতির; বেশির ভাগ গবেষণায় মৌলিক ও প্রায়োগিক বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। অন্যদিকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির পর কিছু কিছু শিক্ষক তার গবেষণাকর্ম বন্ধ করে দেন। অথচ উন্নত দেশে অধ্যাপক হওয়ার পর গবেষণার দায়বদ্ধতা আরো বেড়ে যায়। অনেক সময় গবেষণা করতে না পারলে চাকুরী হারতে হয় বা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পূর্ব থেকেই জানেন যে, গবেষণা কিংবা শিক্ষাদান করুক বা নাই করুক তাদের চাকুরী আজীবন নিরাপদ; তাহলে গবেষণার প্রতি জোর করেও আগ্রহ ও মানসিকতা তৈরি করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে পর্যায়ক্রমে অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী গবেষণাবিমুখ হয়ে পড়ে। এতে উচ্চশিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে অনেকাংশে ব্যার্থ হবে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীর কোনো দেশই প্রাথমিক অবস্থায় তাদের গবেষকদের জন্য যথেষ্ট প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারেনি। এতদসত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ দেশপ্রেম ও দায়বদ্ধতার আলোকে দেশীয় প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে গবেষণার কাজ অব্যাহত রেখেছেন। এদিকে লক্ষ্য রেখে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন উচ্চশিক্ষায় মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণাকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে উক্ত খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে টিকে থাকতে হলে গবেষণার মাধ্যেমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা নিয়ে একটি কৌশলগত পরিকল্পনা থাকতে হবে। উক্ত পরিকল্পনায় আর্থিক বছরে শিক্ষকদের অনুপাত অনুযায়ী কতগুলো গবেষণাপত্র দেশীয় ও স্কোপাস ইনডেক্স জার্নালে প্রকাশ হওয়ার দরকার; কি কি ধরনের মৌলিক ও ফলিত গবেষণা করা উচিত; শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের গবেষণায় কীভাবে যুক্ত করা হবে; গবেষণার ফলাফল সমাজের কল্যাণে কতটুকু ব্যবহৃত হচ্ছে; গবেষণালব্ধ ফলাফল উন্নতমানের জার্নালে প্রকাশিত বা পেটেন্টযোগ্য হলে কি ধরনের প্রণোদনা দেয়া হবে ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থাসহ এর উপর মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে গবেষণা সেল বা দপ্তর থাকবে এবং এর আওতাধীন অনুষদে যে সমস্ত গবেষণা ব্যুরো/কেন্দ্র/ইনস্টিটিউট রয়েছে তাদের গবেষণা পরিকল্পনাকে সুবিন্যস্তভাবে সাজাতে হবে। শিক্ষকগণ নির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণার জন্য প্রস্তাবনাসহ গবেষণা মঞ্জুরির জন্য গবেষণা সেলে বা ব্যুরোতে আবেদন করবে। প্রাপ্ত প্রস্তাবনাসমূহ যাচাই-বাচাইপূর্বক গবেষকের অনুকূলে অর্থ ছাড় করে গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে। তবে বর্তমানে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষককে ঢালাওভাবে মাসিক বেতন বিলের সাথে যে গবেষণা ভাতা দেয়া হচ্ছে তা বিধিসম্মত নয়। গবেষণাসংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনে আই. কিউ.এ.সি-র সহায়তায় অর্থবছরে মঞ্জুরকৃত গবেষণা প্রস্তাবনার গবেষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। বছর শেষে সব গবেষণালব্ধ ফলাফল জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিসহ আন্তর্জাতিক র্যাংকিং-এ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমান্বয়ে প্রথমদিকে জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে।
একটি আত্নমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া সরকারঘোষিত লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য আধুনিক-বিজ্ঞানমনস্ক- কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রয়োজন, যা গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়। ইতিপূর্বে প্রণীত উচ্চশিক্ষার কৌশলগত পরিকল্পনার (২০১৮-২০৩০) সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান ও উৎকর্ষতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
মূলত : গবেষণার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী । তাই গবেষককে তার গবেষণা কর্ম স্বাধীনভাবে করার জন্য গবেষণা সরঞ্জমাদির যোগান দিতে হয়। অনেকেই গবেষণার কথা বললেই, বলে থাকেন দেশে গবেষণার পরিবেশ নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি, গবেষণার জন্য পরিবেশ নয়; দরকার মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন। অনেক শিক্ষক গবেষণাকে প্রাধান্য না দিয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্সে ক্লাস/পার্ট-টাইম চাকুরী/কনসালটেন্সি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তবে খুব কম শিক্ষক নীরবে-নিভৃতে মৌলিক ও ফলিত গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তার উদাহরণও রয়েছে। সংখ্যায় তারা খুবই কম ও প্রচারবিমুখ। কেননা তারা বিশ্বস করে দেশ আমাকে কী দিল সেটি বড় কথা নয়; দেশকে আমি কী দিলাম, সেটিই বড় কথা। গবেষণার এ ধরনের দায়বদ্ধতা ও মানসিকতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অধিকতর গবেষণামুখী হতে হবে।
উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও জ্ঞান সৃষ্টির জন্য গবেষণা অপরিহার্য। এ দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ এড়াতে পারে না। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংখ্যাগত উন্নয়ন বেশ চমৎকার হয়েছে সত্য; কিন্তু মানের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। এমতাবস্থায় উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও উৎকর্ষতার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদারকরণের নিমিত্তে অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাই এগিয়ে আসলেই দ্রুত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ডিরেক্টর, বোর্ড অব ডিরেক্টরস, জীবন বীমা কর্পোরেশন, ঢাকা। কৃতজ্ঞতা : কলম।