শিক্ষার ক্ষতি থেকে উত্তরন কখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ও পর্যাপ্ততায় সম্ভব না, যদি না এটি জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষিত হয় এবং এ লক্ষ্যে কাজ এখনো শুরু হয়। অগ্রাধিকার হতে হবে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, প্রতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সদিচ্ছা ও সংকল্পের ভিত্তিতে; অর্থাৎ রাষ্ট্র এ জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সমর্থন দেবে, সরকার এর বাস্তবায়ন করবে এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাতে সমর্থন করবে এবং শিক্ষায়াতন ও সমাজ তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে।
কাজ শুরুর আগে একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা তৈরিতে দেরি হলে বাস্তবায়ন কঠিন হবে। পরিকল্পনায় থাকবে বর্তমান ক্ষয়ক্ষতি এবং মহামারি চলতে থাকলে সম্ভাব্য ক্ষতি আরও কী হতে পারে, তা নিরুপন; আর্থিক বরাদ্দ কোথায় কতটা দিতে হবে, তা নির্ধারণ; আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং বাস্তবায়নের পর্যায়ক্রমিক একটি ছক তৈরি করা। এজন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা– এই তিন ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে।
মহামারি থেকে মুক্তি মিললেও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরাসরি শ্রেণীকক্ষভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা আরও কিছুকাল চালিয়ে যেতে হবে। মানবিক বিষয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রায়োগিক বিষয়গুলো শ্রেণীকক্ষে দিতে হবে। সেজন্য ইতিমধ্যে যে ডিজিটাল বৈষম্য- অর্থাৎ ৩০-৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যে অনলাইন শিক্ষায় সম্পৃক্ত হতে পারেনি অথবা কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, তা নিরূপন করা একান্ত জরুরী। এই শিক্ষার্থীদের একটি ডাটাবেইস বা নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে এবং কিছুটা সঙ্গতিপূর্ণ পরিবারের শিক্ষার্থীদের সহজ কিস্তিতে ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ পৌছে দিতে হবে। একই সঙ্গে যারা ইতিমধ্যে ঝরে পড়েছে,
তাদেরও এই পরিকল্পনায় নিয়ে আসতে হবে। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের সন্তানদের বৃত্তি আরও বাড়াতে হবে। স্কুলগুলোতে এক বেলা খাবার ব্যাবস্থা করতে হবে। যেখানে তা আছে সেখানে আরও জোরদার করতে হবে। স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী যারা পড়াশোনার অনুপস্থিতিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে অথবা পিছিয়ে পড়েছে, তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য ছুটির দিনে স্কুলে আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজের যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী টিউশন করে কিছু উপার্জন করত, সারাদেশে তাদেরকে ভালো সম্মানী দিয়ে এই কাজে নিয়োগ করা যেতে পারে।
শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। যদি তা নিয়মের বেড়াজালে আটকে যায়, তাহলে তাদের যথেষ্ট আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। মহামারির প্রকোপ কিছুটা কমলে উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে তাদের শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে প্রথমেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমাপ্তি বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য হল খুলে দিয়ে পরীক্ষাগুলো নিয়ে নিতে হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্য শ্রেণির ক্লাস শুরু করা যাবে ।
প্রকোপ একটু কমলে শিক্ষায়াতনগুলো জীবাণুমুক্ত করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে নিতে হবে। এজন্য একটি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের তিনটি কেন্দ্রে বসার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হবে। এজন্য সকল শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা একসঙ্গে নেয়ার প্রয়োজন নেই। সিলেবাস একটু কমিয়ে পরীক্ষা গ্রহণের সময় কমিয়ে প্রয়োজনে অন্য বোর্ডের স্কুল-কলেজ থেকে পরিদর্শক হিসেবে শিক্ষকদের এনে পরীক্ষাগুলো নেয়া যায়।
তবে জাতীয় অগ্রাধিকার থেকে ডিজিটাল বৈষম্য নিরসন এবং অতিরিক্ত সব খরচের জন্য মোটা অংকের অর্থ বরাদ্দের পক্ষে সরকারের সদিচ্ছার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। সরকারকে বঝতে হবে, এর বিকল্প হচ্ছে একটা বিপর্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে পথ চলা। তাতে উন্নয়নের গতি বা সুফল কিছুই আর নিশ্চিত করা যাবে না। প্রয়োজনে দুই একটা মেগা প্রকল্প স্থগিত রেখে শিক্ষার এই মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : বরেণ্য শিক্ষাবিদ। সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কৃতজ্ঞতা : কলম।