আমরা মুসলমান । ইসলাম আমাদের ধর্ম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর প্রচারক। ইসলামের পরিধি ব্যাপক ও সর্বব্যাপী। মানব জীবনের সর্বত্র এর সৌরভ ছড়িয়ে আছে। এই ধারা থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আলাদা করা যায় না। জীবনের সকল ক্ষেত্রের মতো ইসলামের জীবন বিধানকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা করা কঠিন।
সাহিত্য মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি। মানুষের শুভবুদ্ধির উজ্জীবনী শক্তি।
একজন সাহিত্যিক মানব জীবনের সু-প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলেন। সাহিত্যের কাজ মানুষের চিন্তাকে কল্যাণের দিকে উদ্দীপ্ত করা ও বিকশিত করা। সাহিত্য-কোন সম্মোহন বিদ্যা নয় বা কল্পলোকের বিস্তার নয়। সাহিত্য ভাষাগত সম্মোহনী দ্বারা আতœগত বিষয়কে প্রষ্ফুটিত করে। বাস্তবকে ঘিরেই সাহিত্যের প্রকৃত বিচরণ।
সংস্কৃতির ক্ষেত্র আরো ব্যাপক ও গভীর, অতলস্পশী, সৌকর্যমন্ডিত ও বিকশিত। মানব জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি। মানুষ তার জীবনে কীভাবে আল্লাহ ও রাসূল (সা:) নির্দেশিত পথে সাফল্য লাভ করবে তার উদ্দেশ্যে তারই পথনির্দেশ করে সংস্কৃতি। এক কথায় মানব জীবনের চুড়ান্ত সাফল্যের পথ-নির্দেশক সংস্কৃতি। এর ব্যাপকতা জীবনের সবর্ত্র বর্তমান। তাই, যে যতো বেশী পরিশুদ্ধ সংস্কৃতিবান, তিনি ততই পরিশুদ্ধ পরিচ্ছন্ন ও সফল মানুষ। মানব জাতির মধ্যে সর্বাধিক পরিশুদ্ধ মানুষ ও সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা:)। তিনি ছিলেন এক নতুন ও পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতির নির্মাতা।
তার সময় সমাজ ছিল পাপ পঙ্কিলতায়-নিমজ্জিত। পঙ্কিলতা, নির্মমতা,অস্বচ্ছতা, অসাধুতা, পৌত্তলিকতা ও পেশিশক্তিমত্তার, অসহনীয় অনাচারে পরিপূর্ণ।
এমনি এক সময়ে হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর আগমন ঘটে তিনি যখন মানব জাতির কল্যানে, ইসলাম প্রচার শুরু করেন, শত বাধা বিঘেœ ও তিনি অবিচল ছিলেন। কোনো বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষা গ্রহন করেননি। প্রকৃতির শিক্ষায় স্বশিক্ষিত একজন মানুষ। তার ঔদার্য-প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা, বিবেচনাবোধ তাকে সব মানুষের থেকে আলাদা করেছে।
সমাজের মানুষের মধ্যে মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রমান করেছিলেন। তাই সর্বোচ্চ সম্মানে তিনি সম্মানিত। ভাষার শুদ্ধতা সংস্কৃতির পরিচ্ছন্নতা ও মানসিকতায় ছিলেন মহিমান্বিত মানুষ। তিনি এক প্রজ্ঞাবান দূরদর্শী মানুষ ছিলেন।
এমন এক যুগে তিনি মানবজাতির দিশারী হয়ে, কল্যাণকামী পথে দ্বীন প্রচারে লিপ্ত হন। কোনো বাধা-বিঘœ তাকে কক্ষচ্যুত করতে পারে নাই। তার শক্রর কোনো অভাব ছিলনা। তিনি নবুয়্যত প্রাপ্তির পরে স্বয়ং আল্লাহ তাকে শিক্ষা দেন। এক্ষেত্রে ও তিনি সুবিবেচক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ মানুষ। কোনো জাগতিক কালিমা তাকে স্পর্শ করতে পারে নাই। সাহিত্য ও সংস্কৃতির জীবন বোধে নিবিষ্ট ও আতœলগ্ন জীবনাচারের সমম্বয়ে পল্লবিত এক সু-সমম্বিত মানুষ।
আরব জাতির জীবন ও জীবিকা, সপ্ন ও বাস্তবতা,আশা-আনন্দ শক্রতা ও মিত্রতার বাহন ছিল কবিতা। ইতিহাস, বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহন ছিল কবিতা। এক কথায় কবি ও কবিতা, বহুল প্রচলিত ও চর্চিত ছিল।
আরবের কোরাইশ বংশে জন্ম এবং সাদ-বিন বকর বংশে শৈশব অতিবাহিত করেন। কবিতার ছন্দ-উপমা, শব্দ-উৎপ্রেক্ষা ও বাণী রূপকল্পে প্লাবিত সময়ে তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হন। এক কথায় আরবদের মন ও মনন, পথ ও প্রান্তর কবিতার মেঘমালায় আবৃত ছিল।
এরূপ কাব্যময় যুগে জন্মগ্রহণ করে ও নবুয়্যত প্রাপ্তির পূর্বে কোনো কবিতার আসরে যোগ দেননি। দু’একবার-আগ্রহী হলেও অলৌকিকভাবে ঘুমিয়ে পড়েছেন বা পথিমধ্যে অন্য কোনো কারণে ফিরে এসেছেন। এরপর যখন তার ওপর আসমানি কিতাব ও নবুয়্যতের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হলো তখন তাকে শত্রুপক্ষ বলতো কবি ও নাজিলকৃত কিতাব আল-কোরআনকে বলা হতো কবিতা।
এ কথার প্রতিবাদে আল-কোরআনই সোচ্চার হলো। বলা হলো আমি রসূলকে কাব্য রচনা করতে শিখাইনি এবং তার জন্য এটা শোভনীয় নয়। এতো কেবল এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কোরআন।- সূরা ইয়াসিন:৬৯
অতপর ইসলামের সৌন্দর্য্য ও মহিমা প্রচারে অনেক কিছুর মতোই কাফের মুশরিকরা কবি ও কবিতাকে ব্যবহার শুরু করল। আবু সুফিয়ান ইবনুল হাঁরিছ, আব্দুল্লাহ আনবুয যিবারা, ইবন খাত্তাব,হারিছ ইবনে হিশাম, হুমায়রা ইবন ওয়াহাব, আল-মাখযুমি প্রমুখ কবি ইসলামের বিরোধিতায় যখন কবিতা নিয়ে সর্বশক্তিতে নিয়োজিত। তখনই কবি ও কবিতা সম্মর্কে-ইসলামের নীতি-নির্ধারনী দিকনির্দেশনা জারি হলো। আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হলো আরব কবিরা তাদের অনুসরণ করে তো বিভ্রান্তরা। আপনি কি লক্ষ্য করেন না তাদের প্রতি যে, তারা প্রত্যেক প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়? আর তারা তো বলে তা, যা তারা করে না। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে এবং স্মরণ করেছে আল্লাহকে, বারবার প্রতিকার করেছে অত্যাচারিত হবার পর, শিগগিরই জানবে তারা জুলুম করেছে কোন জায়গায় তারা ফিরে যাবে?।- সূরা: শোয়ারা: ২২৪-২২৭
কোরআনে কারিমের এ আয়াতে কবি ও কবিতা তথা সাহিত্য সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোরআনের বাচনভঙ্গি, ভাষাশৈলী ও উপস্থাপনা পদ্ধতির কারনে নব দীক্ষিত মুসলিম কবিদের কাছে হঠাৎ ম্লান হয়ে যাওয়া কবিতা আবার নবজীবন লাভ করে এর সাথে যোগ হয় রাসূলুল্লাহর (সা:) উৎসাহ উদ্দীপনা। নবুওয়াতির দায়িত্বের ফাঁকে ফাঁকে তিনি সাহাবি-কবিদের কবিতা সম্পর্কে খোজ খবর নিতেন। তাদের কবিতা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। তাদের কবিতার শুদ্ধতার প্রতি নজর রাখতেন ও উৎসাহিত করার জন্য পুরষ্কৃত করতেন।
সম-সাময়িক কবিদের কবিতা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করতেন। মহানবীর (সা:) এসব কথায় সারমর্ম ছিল। শিল্পকলা তথা সাহিত্যের সৌন্দর্য এবং জীবনের সৌন্দর্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এভাবেই ইসলামের গৃহাঙ্গনে কবি ও কবিতা স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠে। কাফেরদের সমুচিত জবাব ও নও-মুসলিমদের আতœ-ত্যাগ ও আতœশক্তিতে বলিয়ান করার ক্ষেত্রে সাহাবি-কবিদের কবিতা এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন- হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা:) হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা:), হযরত কাব বিন মালিক (রা:), হযরত লবিদ বিন রাহিয়া (রা:) প্রমূখ।
এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) নিজেও সাহাবিদের কবিতার বিষয় হয়ে ওঠেন। তার সৌন্দর্যমন্ডিত জীবন, স্নেহসিক্ত ও দয়ার্দ্র হৃদয়, মানুষের ও মানবতার প্রতি তার অকৃত্রিম ও অভাবনীয় ভালোবাসা সাহাবি-কবিদের ও বিমুগ্ধ করে। তারা কবিতার ভাষায় তার জীবনের নানা-দিক উচ্চকিত করে তোলেন।
তার ইন্তেকালের পরেও এ ধারা অব্যাহত ও বিকশিত হয়। আরবের সীমানা ছাড়িয়ে দুনিয়ার সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল-প্রশান্তি বা রাসূলের শানে কবিতা নামক এই সমুজ্জ্বল ধারা আজ পৃথিবীর সব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র মানুষ, যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার কবিরা মুখরিত হয়েছেন। আরবি,ফার্সি, তুর্কি, ইংরেজি, জার্মানি, ফরাসি, মালয়, উর্দূ, হিন্দি ও বাংলা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব ভাষার সব কবির অনুভূতিতে একই সুর‘রুহি ফিদাকা ইয়া রাসূলল্লাহ’। হে-আল্লাহর রাসূল! আমার সত্তা যেন তোমায় উৎসগির্ত হয়। এই আবেগ ভালোবাসা শুধু কবিতার নয় সাহিত্যেও প্রায় সব শাখা যেমন- নাটক, গল্প, উপন্যাসেও আলোড়িত ও আলোকিত। তার নামের যাদুস্পর্শে অনেক ভাষার গতি পাল্টে গেছে। ভাষার গাঁথুনি হয়েছে সমৃদ্ধ। বিকশিত হয়েছে ভাব ও অন্ত:সত্তা, সম্দ্ধৃ হয়েছ শব্দ ভান্ডার, সম্প্রসারিত হয়েছে আবেগ ও উদ্দীপনা,সম্মোহনী শক্তি ও উজ্জীবনী প্রভা। সাহিত্যের সৌকর্যের সাথে জীবনের সৌন্দর্যকে একান্ত করে দিয়েছে যা সাহিত্য সংস্কৃতির একই বাঁকে মিলিত হয়েছে।
লেখক : সমন্বয়কারী, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি