দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিরোধিতাকে পরাজিত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ জাতি বিজয় অর্জন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পরাজিত হয় ’৫২, ’৫৪, ’৬১, ’৬৬, ’৬৯, ’৭০-এর বাঙালি চেতনার বিরুদ্ধাবলম্বনকারী শক্তি। কিছুদিনের জন্য পরাজিত শক্তি চুপচাপই ছিল, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয় দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের বিরোধীপক্ষ ’৭১-এর পরাজিত শক্তি। আসলে ওই দিন যারা রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে তারা মূলত আবার পূর্ব পাকিস্তানকেই কায়েম করে। মোশতাক, জিয়ার নেতৃত্বে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন হয় আজীবন বাঙালিত্বের বিরোধিতাকারী অপশক্তি। ইতিহাসের চাকা ঘুরতে থাকে পেছনের দিকে। ১৯৭৬ সালের ৩ মে এক ফরমান জারি করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনর্বাসিত করেন। রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে। ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ কেড়ে নিয়ে কিছুদিন পর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে আইয়ুবীয় কায়দায় হ্যাঁ-না ভোটে ৮৮.৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে ৯৮.৮৮ শতাংশ ভোট তার পক্ষে দিয়েছে বলে প্রচার করেন। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই পিপিআর ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। যদিও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় আরো দুটি আওয়ামী লীগ তৈরির চেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগে একাধিক বিভাজন সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু সময়ের পরীক্ষায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মূল আওয়ামী লীগই টিকে যায়। ১৯৮১ সালের ১৩-১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সময় ভাগ্যক্রমে বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন দিল্লিতে। সভাপতি পদ গ্রহণে শেখ হাসিনাকে রাজি করানো এবং দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগের অংশ হিসেবে দিল্লিতে একাধিক বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। তাদের মধ্যে ছিলেন আবুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী, জোহরা তাজউদ্দীন, সাজেদা চৌধুরী, ডা. এস এ মালেক, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ।
২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিল্লিতে কয়েক দফা বৈঠক হয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের। ইতোমধ্যে পাকিস্তানপন্থি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিএনপি দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করে শেখ হাসিনার দেশে ফেরা প্রতিরোধের জন্য। তারা সারাদেশে প্রচুর লিফলেট ও হ্যান্ডবিল বিতরণ করে। জয় ও পুতুল জলবসন্তে আক্রান্ত হওয়ায় শেখ হাসিনার ঢাকা প্রত্যাবর্তন কয়েকদিন বিলম্বিত হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দুপুর ১২টায় পুতুলকে নিয়ে ঢাকায় আসেন শেখ হাসিনা। লাখ লাখ মানুষ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়েছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় যখন শেখ হাসিনা গণসংবর্ধনার মঞ্চে দাঁড়ালেন তখনো প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়েছিল কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ। শেখ হাসিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবেগময় ভাষণ দেন। তবে ভাষণে দৃঢ়তার কোনো অভাব ছিল না। আওয়ামী লীগের মতো স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী বৃহৎ সংগঠনটিকে নেতৃত্বদানে যে তিনি নিশ্চিতভাবে সফল হবেন তার বক্তৃতায় সে লক্ষণই পরিলক্ষিত হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ তার আগমনে গণজোয়ার নিয়ে আসে সারাদেশে। হতাশাগ্রস্ত আওয়ামী লীগ কর্মীরা সুসংগঠিত হতে শুরু করে। বিপন্ন যে জাতি দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের সব অর্জন হারাতে বসেছিল, তাদের মনে আবারো হারানো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ফিরে পাওয়ার আশা ফিরে আসে। শুরু হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের পথচলা। এরই মধ্যে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানে নিহত হন। অবশ্য এটি ছিল জিয়ার আমলে অনেক সামরিক অভ্যুত্থানের একটি। ’৭৫ থেকে ’৮১ সাল পর্যন্ত সময়ে সেনাবাহিনীতে বহু অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে প্রাণ দিতে হয় হাজার হাজার সেনাসদস্যকে। তাদের অনেককেই বিনাদোষে জিয়াউর রহমান হত্যা করেছিলেন বলে বহু প্রমাণ আছে।
জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদও হ্যাঁ-না গণভোটের খেলা আয়োজন করেছিলেন। এবার ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৯৫ শতাংশ, যার ৭১ শতাংশ এরশাদের ১৮ দফা কর্মসূচির পক্ষে। সামরিক শাসন চলতে থাকে। ১৯৮৩ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগের ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। ৯ এপ্রিল হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের এক সম্মেলনে শেখ হাসিনা সামরিক শাসনবিরোধী ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৮৬ সালের মার্চে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করে। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে কয়েকবার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সমাবেশমুখী মিছিলে গুলি চালিয়ে এরশাদের পেটুয়া বাহিনী ৩৮ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। শুরু হলো শেখ হাসিনাকে হত্যার আনুষ্ঠানিক মহড়া, যা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ‘ভাঙা সুটকেস’ বাহিনীর অন্যতম কর্ণধার হাওয়া ভবনখ্যাত তারেক রহমানের নেতৃত্বে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ পায়।
‘লেডি (মেরি)-পীর-বাম-রাজাকার-গোয়েন্ দা’ শাসিত শাসনব্যবস্থার ভিত রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় অনুশাসনের বহু দূরে অবস্থানকারী এরশাদ রাষ্ট্রের জন্য ধর্ম নির্ধারণ করে দেন ইসলাম। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতি নিয়ে রাজনীতিই ছিল এর উদ্দেশ্য। কোনো কিছুতেই এরশাদের শেষ রক্ষা হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলন এত বেগবান হয় যে জরুরি অবস্থা জারি করেও এরশাদ ব্যর্থ হন। সামরিক-বেসামরিক আমলারা পক্ষ ত্যাগ করতে শুরু করেন। আ স ম রব ও মওদুদরা পিছুটান দিতে থাকেন। ১৯৯০-এর ৬ নভেম্বর শেখ হাসিনা পান্থপথের জনসভায় সাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ দেখান। ৬ ডিসেম্বর সেই রূপরেখা অনুযায়ী এরশাদ শাসনের অবসান হয়। তারপরও ষড়যন্ত্রকারীরা দমে যায়নি। ১৯৯১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সূক্ষ্ম কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে ক্যান্টনমেন্টবাসী। ক্যান্টমমেন্টে অবস্থানকারী খালেদা জিয়ার দল ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে জামায়াতের সহযোগিতায় ক্ষমতাসীন হয়। ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েও আসনসংখ্যার হিসাবে আওয়ামী লীগ আবারো রাজপথে। ক্যান্টনমেন্ট নিবাসী খালেদা জিয়া তার উত্তরসূরি ক্যান্টনমেন্টবাসী জিয়া-এরশাদের মতোই নির্যাতন, নিপীড়ন, লুণ্ঠন, সীমাহীন দুঃশাসনের রাজত্ব কায়েম করেন। ১৯৯২ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসে উদ্যোগী হন। বিভিন্ন কমিটি ও উপ-কমিটি গঠন করে দলীয় রাজনীতিতে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় মেধার সমাবেশ ঘটান। আওয়ামী লীগ তার ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রেখে আধুনিক মানসিকতার দলে রূপান্তরিত হয়। ঘাতক-দালাল নির্মূল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনও বেগবান করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের এক নির্বাচন করে বিএনপি, কিন্তু ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। ৩০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন।
২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে অংশ নেন। শেখ হাসিনার বিজয় আঁচ করতে পেরে ক্যান্টনমেন্টবাসী অন্ধকারের শক্তি আবারো অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়, জাগ্রত জনতার প্রতিরোধের ভয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিচক্ষণতায় তা ব্যর্থ হয়। ২৩ জুন সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাংলার জনগণ তাদের হৃত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আবার ফিরে পায়। আবার সক্রিয় হয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা। ২০০১ সালে পাকিস্তানপন্থিদের আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা হয়। এবার জামায়াতে ইসলামী চলে আসে ক্ষমতার কেন্দ্রে, মন্ত্রিসভায় ঠাঁই করে নেয় তারা, জঙ্গি উত্থানের সব পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, সামরিক গোয়েন্দারা হাওয়া ভবনের সঙ্গে মিলেমিশে শুরু করে অস্ত্র এবং মাদকের ব্যবসা, দশ ট্রাক অস্ত্র এরই অংশ। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলাসহ পরিচালনা করা হয় একাধিক হত্যাপ্রচেষ্টা। একই ধারায় দেশ চলে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত। এমনকি ২০০৭-০৮ সালে আবারো দেশকে দখলে নেয় পাকিস্তানি মানসিকতার সামরিক গোয়েন্দা ব্রিগেডিয়ার বারী ও আমিনরা। একমাত্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তার কারণেই ২০০৯-পরবর্তী বাংলাদেশ সেনা বা সেনাসমর্থিত শাসনের অবসান হয়। বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নয়নের মহাসড়কে।
লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।