চতুর্থ পর্ব
আমাদের দেশে নির্বাচন অথবা অন্য কোন অবৈধ উপায়ে যখনই সরকার বদল হয় তখন দেখা যায় প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করা হয় এবং প্রচুর লোককে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) ‘ওএসডি’ করে রেখে দেয়া হয় অথবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় । দলীয়করণের সমালোচনা থেকে বাঁচতে অথবা বিশেষ কারণে সেনাবাহিনী বা পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা হলে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র অথবা ক্রীড়া ও যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার একটা প্রথা এ দেশে প্রচলিত ছিল । এটা আমাদের দেশে বেশ সমালোচনার বিষয় হলেও মার্কিন দেশে এটাই রেওয়াজ । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনই কয়েক হাজার লোকের চাকরিচ্যুতি (চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পরিসমাপ্তি) অথবা বদলির ঘটনা ঘটে। হোয়াইট হাউস এবং ক্যাপিটল হিলে নতুন লোক চলে আসে , আগের প্রশাসনের লোকেরা বিদায় নেয় । এটাই মার্কিন মুলুকের প্রথা । কারণ ডেমোক্রেটিক দলের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো রিপাবলিকান সমর্থিত কর্মকর্তাদের দিয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় ।
আমাদের দেশেও সরকার বদল হওয়ার সাথে সাথেই কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আসে । এখানেও মনে করা হয় জামাত-বিএনপি’র লোক দিয়ে আওয়ামী লীগের আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব নয় । অথবা আওয়ামী লীগের লোক দিয়ে জামাত-বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় । (২০০১ সালে নির্বাচনের পর জামাত-বিএনপি জোট যখন ক্ষমতাসীন হয় এর সাথে সাথেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীকে অপসারণ করা হয় । এই অপসারণের জন্য সমসাময়িক কালের কোন আইন বিদ্যমান না থাকায় ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত, খুব সম্ভবত ১৮৭৬ সালের, একটি আইনকে কাজে লাগানো হয় । যেদিন প্রফেসর এ কে আজাদ চৌধুরীকে অপসারণ করা হয় সেদিনই অধ্যাপক ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরীকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় । নিয়োগ পত্রটি সন্ধ্যার দিকে স্বাক্ষরিত হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায় । যতদূর মনে পড়ে রাত দশটার পরে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের কলাপসিবল গেট খুলে ঐ রাতেই ড.আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী উপাচার্য পদে গদিনাসীন হন এবং তাঁর দলের লোকেরা তাঁকে রাতেই ফুল দিয়ে বরণ করেন ।) যদিও অনেকে বলেন সরকারি কর্মকর্তাদের দল থাকে না, দল থাকা উচিত না, তাঁরা রাষ্ট্রের বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন আর নির্দলীয় এবং রাজনৈতিক দলীয় আদর্শের সাথে সম্পর্কহীন ব্যক্তি দেশে কমই অবশিষ্ট আছে । দলীয়করণ বলে সমালোচনা থাকলেও এটাই বাস্তবতা । সরকারের প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য তাঁরা তাঁদের সমমনা লোকদেরকেই key position গুলোতে বসাতে চায় । অনেকে মনে করেন এটাই হওয়া উচিত । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সমমনাদের (এদের মধ্যে অনেকেই থাকে যারা সবসময়ই বর্তমান ‘ সরকার মনা ‘ ! ) মধ্য থেকেও অনেক সময় অযোগ্যরাই দায়িত্ব পেয়ে যায় । আর সেখানেই হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের বা সঠিক কাজটি সঠিকভাবে করার বিড়ম্বনা ।
সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন মূল্যবোধ(shared values) তৈরি এবং বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ । এর দ্বারা প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি গাইডলাইন তৈরি হয় এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের একটা নৈতিক দিক নির্দেশনা তৈরি হয় । যখন কর্মীরা বুঝতে পারেনা কি করতে হবে, তখন মূল্যবোধ তাঁকে নির্দেশনা দেয় , “values tell you what to do when you don’t know what to do” (Bob Vanourek and Gregg Vanourek, 2014)। মূল্যবোধ বলে দেয় কি করা যাবে আর কি করা যাবে না । সঠিক কাজটি সঠিকভাবে করতে গেলে যারা কর্মটি বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত হবেন তারা যদি সমমনা (like minded/ share values) না হয় তাহলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় । টুকটাক বিষয়েও তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয় এবং কাজ বিলম্বিত হয় । McKinsey 7-S ফ্রেমওয়ার্কের চতুর্থ “S” টি হচ্ছে “shared values” । এটা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দ্বারা তৈরি হয় এবং অন্যান্য সদস্যরা সেটা গ্রহণ করেন । মূল্যবোধগুলো সবাই পরস্পরের মধ্যে সঞ্চারিত করে এবং সংগঠনের কাজ করার সময় সেগুলোকে অনুসরণ করে । প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত মিশন স্টেটমেন্টে কোম্পানির ‘কোর ভ্যালু’ গুলো লিপিবদ্ধ থাকে । প্রতিষ্ঠানটি কি ? কি করছে ? কি করতে চায় ? এর একটা প্রতিফলন থাকে মিশন বিবৃতিতে । অভিন্ন মূল্যবোধ নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সংগঠনের সদস্যরা যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করে । প্রতিষ্ঠানটিকে নৈতিক ও আদর্শিক বিচ্যুতি, এমনকি আইন ভঙ্গের দায় থেকে রক্ষা করে । সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্তের আচরণ, লক্ষ্য উদ্দেশ্যের উপর সাধারণ মূল্যবোধগুলো আরোপ করে অভিন্ন মূল্যবোধ বাস্তবায়িত হলে সকল স্টেকহোল্ডারদের চাওয়া পরিতৃপ্ত হয় । অভিন্ন মূল্যবোধ পারস্পরিক শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করে, একজন প্রতি আরেকজনের সহমর্মিতা তৈরি হয়, পরস্পরকে ভালোবাসে, শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তাঁরা কর্মস্থলকে ভালোবাসে ।
২০১১ সালের ‘Harvard বিজনেস রিভিউতে’ প্রকাশিত “Creating shared values” শীর্ষক প্রবন্ধে Michael Porter ও Mark Kraman অভিন্ন মূল্যবোধ (shared values) ধারণাটি বিবৃত করেন এবং এর গুরুত্ব তুলে ধরেন । তাঁদের মতে অভিন্ন মূল্যবোধ হচ্ছে, “policies and operating practices that enhance the competitiveness of a company, while simultaneously advanceing the economic and social conditions in the communities in which it operates. Share value creation focuses on identifying and expanding the connections between societal and economic progress”।
কর্মীদের পরিপূর্ণ সংযুক্তি(engagement) বা আন্তরিক অংশগ্রহণের জন্য অভিন্ন মূল্যবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কোম্পানির উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য কর্মীদের এংগেজমেন্ট অন্যতম একটি মূল উপাদান । কোম্পানির ভ্যালু যার সাথে ‘ভিশন-মিশন’ সম্পর্কিত তার থেকে অভিন্ন মূল্যবোধ বিষয়টা আলাদা । অভিন্ন মূল্যবোধ কোম্পানির অভ্যন্তরে একজনের সাথে অন্যের মিলন ঘটায় । কর্মস্থলে অভিন্ন মূল্যবোধ এর অর্থ হচ্ছে কর্মীরা একই ধরনের কর্ম মনোভাব এবং নীতি তাঁদের সহকর্মীদের সাথে শেয়ার করে । যার ফলে সতীর্থদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক আস্থা, সহমর্মিতা এবং সৌহার্দ্য তৈরি হয়। এর দ্বারা কর্মীদের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ কিভাবে সংগঠনে কাজ করে সেটা দেখা যায় এবং এবং ফলাফল প্রতিফলিত হয় । অভিন্ন মূল্যবোধ এবং বন্ধুত্ব হাত ধরাধরি করে চলে । বন্ধুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ, আন্তরিকতা, কাজের প্রতি কমিটমেন্ট ও শ্রদ্ধা, এবং আনুগত্য কোম্পানিতে কর্মীদের এংগেজমেন্টের বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে । দরিদ্র, পশ্চাৎপদ এবং পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে যে সকল এনজিও কাজ করে তাঁরা কর্মী নিয়োগ করার সময় এই কাজের প্রতি যাদের অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিয়োগকৃত কর্মীরা যাদের সেবা দিবে তাঁদের প্রতি চাকরি প্রত্যাশীর মনোভাব এই বিষয়গুলোকে কর্মী নিয়োগের সময় প্রাধান্য দেয় । আমাদের দেশে অনেকগুলো এনজিও আছে যারা কর্মী নিয়োগের সময় ছাত্র রাজনীতি এবং গ্রুপকে সংগঠিত করে গ্রুপ ভিত্তিক কাজ করার অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেয় । বিশেষ করে বামপন্থী এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র সংগঠন করা ব্যক্তিরা এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায় । কারণ নিয়োগের সাথে সংশ্লিষ্টরা মনে করে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডের সাথে এই সকল ব্যক্তিরা সহজেই সহমর্মিতা পোষণ করবে এবং আন্তরিকভাবে কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হবে । এনজিওগুলোর এই দৃষ্টিভঙ্গি হার্জবার্গের টু ফ্যাক্টর থিওরি দ্বারা সমর্থিত (Herzberg et al.’s; 1959) । হার্জবার্গের টু-ফ্যাক্টর থিওরিতেও কাজের অভ্যন্তরীণ আনন্দকে (intrinsic value) প্রেষণার অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
এম্প্লয়মেন্ট এংগেজমেন্ট স্পেশালিস্ট প্রতিষ্ঠান ’15five’ এর এক গবেষণায় দেখা গেছে ১০ বছর একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পরেও কর্মীদের অভিন্ন মূল্যবোধ এবং বন্ধুত্বের স্কোর সর্বনিম্ন থেকে গেছে । যদিও ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিখ্যাত কনসাল্টিং ফার্মটি মনে করে, “we believe that today’s global, knowledge based economy, a company’s true power lies in its people and culture” । বিভিন্ন জেনারেশনের লোকের সমন্বয়ে গঠিত জনশক্তি, বিভিন্ন বয়স এবং অভিজ্ঞতার কারণে কর্মীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় । অভিজ্ঞতা সবসময় উপকারী নয় । পরবর্তী প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা আসেন সেই অভিজ্ঞতা অনেক সময় নতুন প্রতিষ্ঠানের অভিন্ন মূল্যবোধ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য থাকাকালে এই বিষয়টায় আমার বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়েছিল । বাংলাদেশ নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটু ব্যতিক্রম । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকরা বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে এখানে যোগ দিয়েছিলেন । প্রত্যেকের পড়াশোনার বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা , পূর্ববর্তী চাকরির বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজও ভিন্ন ভিন্ন। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার শিক্ষকদের যে সাংস্কৃতিক মিশ্রণ তৈরি হয় তা আবার নবীন এবং শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাহীন শিক্ষকদের মূল্যবোধের সাথে দ্বান্দ্বিকতা তৈরি করে । নবীন শিক্ষকদেরও প্রায় ৯৫% এসেছেন দেশের বিভিন্ন পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । যে যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধকে সাথে নিয়েই তাঁরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যোগদান করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নিয়োগকৃত শিক্ষকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈপরীত্য লক্ষ্য করেছি । এর সাথে যদি আরো দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে কেউ একই বিভাগে যোগ দেয় তাহলে কি সমস্যা হতে পারে সেটা আমি দেখেছি কয়েকটি বিভাগে । অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত যেমন- চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চেয়ারম্যানকে প্রত্যাহার করা, উপাচার্যের উপস্থিতিতে উপাচার্যের মিটিং রুমে বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির মিটিং ডাকা, একাধিক সালিশী মিটিং করা, বিভাগীয় সহকর্মীদের পারস্পরিক মতানৈক্য নিরসনে কোষাধ্যক্ষকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া, ইত্যাদি করতে হয়েছে । একই বিভাগের সহকর্মীদের মধ্যে মতবিরোধের অনেক যৌক্তিক কারণ থাকলেও, পঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক গ্রুপিংকে সক্রিয় থাকতে দেখেছি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য কারণে অনেক সমস্যা থাকলেও এই সমস্যাটি কম, কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রায় শতভাগ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং একই বিভাগের ছাত্র ছিলেন । যার কারণে এখানে যতটা অভিন্ন মূল্যবোধ দেখা যায় সেটা তৈরি হতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা সময় নেবে । তাছাড়া প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান মূল্যবোধের একটি ধারাবাহিকতা থাকে এবং সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় । জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বয়স কম হওয়ায় সেই ধারাবাহিকতাটি এখনো তৈরির পর্যায়ে । তবে এটা স্বীকার করতে হবে বিগত ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিন্ন নীতিবোধের ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অনেক এগিয়ে গেছে । এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ‘হেকেপ’ প্রোজেক্টের ‘আইকিউএসি’ কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছে । আশার কথা হচ্ছে অতীতের অভিজ্ঞতা এবং নীতিবোধের স্বাতন্ত্র্য সব সময় অভিন্ন মূল্যবোধ তৈরির অনতিক্রম্যযোগ্য প্রতিবন্ধকতা নয় । নেতৃত্তের দিক থেকে অভিন্ন মূল্যবোধ তৈরীর ক্ষেত্রে জোড়াজুড়ির করারও কিছু নেই। প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব এবং পেশাগত মূল্যবোধ থাকে, বৈচিত্রের মধ্যেও সুদৃঢ় অভিন্ন মূল্যবোধ তৈরি সম্ভব ।
কোম্পানির নেতৃত্ব কর্মীদের সমমনা ও বন্ধুত্বপূর্ণ হতে সাহায্য করতে পারে । এর জন্য পদক্ষেপগুলো হচ্ছে- কোম্পানির ভিশন কি হওয়া উচিত সেটা নিয়ে কর্মীদের সাথে মত বিনিময় এবং এবিষয়ের প্রতি তাঁদের সমর্থন আদায় । দ্বিতীয় যে কাজটি নেতৃত্ব থেকে করা যেতে পারে সেটা হচ্ছে- সহকর্মীদের মধ্যে অভিন্ন মূল্যবোধ তৈরীর ক্ষেত্রে
Mentorship চালু করা । আর তৃতীয় কাজটি হচ্ছে কর্মীদের এংগেজমেন্ট মাঝেমধ্যেই পরিমাপ করে দেখা । আসলে পুরো ব্যাপারটাই একটা ইকোসিস্টেম ।
অভিন্ন মূল্যবোধ তৈরীর ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ নজর দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয় (Kramer and Pfitzer,2016) । কোম্পানি এবং কর্মীদের মূল্যবোধের মৌলিক মিলগুলো সংজ্ঞায়িত করা এবং এগুলো জোরালোভাবে তুলে ধরা; কর্মীদের এঙ্গেজমেন্ট কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে এটা নিয়েও তাঁদের সাথে খোলামেলা আলাপ করা এবং তাদের পরামর্শ আমলে নিয়ে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু করা; কোম্পানি এবং কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাটি এমনভাবে স্থাপন করা যাতে একটি স্থায়ী রূপ পায়, কোন অবিশ্বাস তৈরি না হয়, যার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক আস্থা তৈরি হয়, এবং যৌথ উদ্দেশ্য অর্জনের দিকে কর্মীরা ধাবিত হয় । সবশেষে অভিন্ন মূল্যবোধ তৈরীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা দৃশ্যমান করতে হবে এবং এর জন্য একটি ‘সেল’ তৈরি করে সেখানে mentor নিয়োগ করে বিষয়টা নিয়মিত মূল্যায়ন করে জোরালো করার চেষ্টা নিতে হবে। কর্মীদের মধ্যে “আমার কোম্পানি”(my company) বোধ তৈরি করার জন্য আজকাল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে । ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের বাইরে তাঁদেরকে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে উৎসাহ প্রদান এবং পারস্পরিক মেলামেশার সুযোগ করে দেয় । অনেক কর্পোরেট হাউজের এখন নিজস্ব ক্লাব, ফুটবল এবং ক্রিকেট টিম আছে, এমনকি তাঁরা নিজস্ব ব্যান্ড মিউজিকের গ্রুপ তৈরি করেছে । ফুটবলের সোনালী যুগে বিজেএমসি টিম একবার ঢাকা লিগের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল । বসুন্ধরা কিংস এখন সেই চেষ্টাই করছে । সবই করা হচ্ছে কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব, ভাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা এবং শেষ পর্যন্ত অভিন্ন মূল্যবোধ (shared values) তৈরীর লক্ষ্যে । (…চলবে)
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়