একটা মজার গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। এটি ১৯৯৯ সাল ও এর পরবর্তী সময়ে। তবে অবশ্যই ২০০৫ সালের মধ্যকার। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শামসুন নাহার হলে আমাদের এক বন্ধুর বসবাস ছিল। কখনো তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে একটা এবং একমাত্র প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হতো। হল গেটে স্টাফ বা অন্য কোনো পরিচিত-অপরিচিত বন্ধু, বড়বোন-ছোটবোনের কাছে ধর্ণা ধরতে হতো। তাদেরকে অনুরোধ করে চিরকুটে বন্ধুর নাম ও রুম নম্বর লিখে ধরিয়ে দিতাম। এর নাম ছিল ‘কল’ দেয়া। খুব বিনয়ের সঙ্গে, যাতে কলগ্রহণকারী খুশি হন, বলতাম, ‘প্লিজ, একটা কল নেবেন।’ এটা এজন্য যে, তিনি ভেতরে গিয়ে যেন সদয় হয়ে বন্ধুটিকে ডেকে দেন। নইলে সাক্ষাৎ মিলবে না। এই প্রক্রিয়ায় কখনো ‘নির্দয়’ হয়ে কেউ ডেকে না দিলে আবার আরেকজনকে একইভাবে চিরকুট ধরিয়ে দেয়ার তপস্যা চলতো। একই ধরনের রীতি অবশ্য ছাত্র হলগুলোতেও ছিল।

এই গল্প নিশ্চয়ই আমাদের এখনকার উত্তরসূরিদের কাছে ‘আষাঢ়ে গল্প’ মনে হলেও হতে পারে; যদিও তা নয়। হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। ছেলে বন্ধুটি হয়তো নিজের হল থেকে বের হওয়ার সময়েই মেয়ে বন্ধুটিকে বা মেয়ে বন্ধুটি তার ছেলে বন্ধুটিকে ‘কল’ করছে। তবে তা আর চিরকুটে নয়, ইথারে; ‘আসছি, আসো।’ হোয়াটসআপ, ভাইভার, ইমু, ম্যাসেঞ্জারের সুবাদে আরও কত কী হচ্ছে- সে কথা না হয় বাদই দিলাম।
মোবাইল টেকনোলজিসহ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবাদে এই পরিবর্তন। এটাকে ইতিবাচক বলবো, না নেতিবাচক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে এই সেবা যে হল গেটের কর্মচারীদের বেকার করেছে বা হলের অন্য ছাত্রীদের উটকো ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে- তাতে সন্দেহ নেই। অন্যভাবে বললে, ‘কল’ দেয়াকে কেন্দ্র করে কিছু কর্মচারীর বাড়তি ও টুকটাক আয়ের রাস্তাও বন্ধ করেছে এই টেকনোলজি। অর্থ্যাৎ, মানব-সভ্যতায় টেকনোলজির উপস্থিতি জীবনকে সহজ করার পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিক নিয়ে এসেছে। গণমাধ্যম বিশেষ করে সাংবাদিকতায় এই দুই প্রভাবের বিষয়েই এখানে আলোকপাত করা হবে।

দুই.
মানবসভ্যতার ইতিহাসে আজ পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব গত হয়েছে। বর্তমানে আমরা যে সময়টায় প্রবেশ করেছি সেটি ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কাল’। প্রাত্যহিক জীবনে টেকনোলজির এই যে ব্যবহার এবং তার ফলে মানবসভ্যতায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, তাকেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলে অভিহিত করা হচ্ছে। প্রথম শিল্প বিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। মূলত ডিজিটাল বিপ্লবকেই বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।

তিন.
প্রশ্ন হচ্ছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কী? ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান অধ্যাপক ক্লস শোয়াব (কষধঁং ঝপযধিন) প্রথমবারের মতো এটি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আনেন। ফোরামের ৪৬তম বার্ষিক সভা সামনে রেখে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি এই বিপ্লবের বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। তার মতে, স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ (কৃত্রিম মানুষ), রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে। ওই প্রবন্ধে ক্লস শোয়াব আরও বলেন, আমরা চাই বা না চাই, এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে, সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এই বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনো হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে। যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া।’ গতবছর বিশ্বব্যাংক ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে কীভাবে যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উপার্জন হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে নির্ভরতা কতটা বেড়েছে সে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

চার.
প্রশ্ন উঠেছে, অনাগত সেই পরিবর্তন, গতি আর চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বা সাংবাদিকতার অবস্থান কোথায়? এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধানের চেষ্টাও হয়েছে ইতিমধ্যে। সম্প্রতি** যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বেসরকারি রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয় জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিকে সঙ্গে করে বিশ্বের ১৩০টি দেশে ১২টি ভাষায় সমীক্ষায় চালায় ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস’ (আইসিএফজে)। সংস্থাটি তাদের সমীক্ষার নির্বাহী সার-সংক্ষেপে উল্লিখিত প্রশ্নের জবাব তুলে ধরে বলেছে, ‘আমাদের সমীক্ষা একটি ক্রিটিক্যাল (স্পর্শকাতর) প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে। তা হচ্ছে, ডিজিটাল বিপ্লবের সঙ্গে সাংবাদিকরা কী গতিশীল থাকতে পারছে? নতুন প্রযুক্তির বড় বড় উদ্ভাবন সত্ত্বেও আমাদের কাছে উপসংহার হচ্ছে, না।’
সমীক্ষায় আইসিএফজে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা-সংশ্লিষ্ট ২৪ ধরনের মৌলিক প্রবণতা চিহ্নিত করেছে। এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বার্তাকক্ষগুলো এখন পর্যন্ত গভীরভাবে টেকনোলজির ঘাটতি (গ্যাপ) মোকাবেলা করছে। অর্থ্যাৎ, মানুষের কাছে সময়মত ও সঠিক তথ্যসহ (সোর্সকে ব্যবহার/প্রকাশ বা ঝুঁকিতে ফেলা ছাড়া) পৌঁছানোর মিশনে যেতে সাংবাদিকদের ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি বেশ। বার্তাকক্ষের মাত্র ৫ শতাংশ কর্মীর টেকনোলজি-সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি আছে। ২ শতাংশ কর্মীর টেকনোলজির বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। ডিজিটাল বিপ্লব ঘটে চললেও বেশির ভাগ বার্তাকক্ষ (৮২ শতাংশ) সনাতনী স্থাপনা দিয়েই চলছে। অর্থ্যাৎ, ওইসব গণমাধ্যমের রিপোর্টার, সম্পাদক, সম্পাদকীয় লেখকরা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে কম সম্পৃক্ত। অধিকাংশ গণমাধ্যম মৌলিক বিশ্লেষণী ডেটা ব্যবহার করে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। এটা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে পিছিয়ে রাখে। অথচ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কোম্পানি, এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি বা অন্য প্রযুক্তি-পরিচালিত কোম্পানি ভোক্তার আচরণ ও ব্যবহারকারীর প্রত্যাশা-সম্পৃক্ততা পর্যালোচনা ও বিবেচনা করে।
এ অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সম্পাদক, ডিজিটাল কনটেন্ট উৎপাদক, অ্যানালাইটিক এডিটর গোত্রীয় মাত্র ১৮ শতাংশ গণমাধ্যমের নতুন ডিজিটাল সংশ্লিষ্টতা (জড়ষব) পরিলক্ষিত হয়েছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, বিশ্বের অর্ধেকেরও কম সাংবাদিক ও বার্তাকক্ষ (গণমাধ্যম) তাদের যোগাযোগ সুরক্ষিত রাখে। সাংবাদিকদের অত্যাধুনিক ডিজিটাল দ্রব্যাদি ব্যবহার প্রবণতা, জ্ঞান ও এরসঙ্গে পরিচিতি খুবই কম। যারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করেন তারা তা করেন কেবল প্রতিবেদনের ধারণা খুঁজতে। এক্ষেত্রে দৈন্য এমনই যে, মাত্র ১১ শতাংশ ভেরিফিকেশন টুলস ব্যবহার করে। সমীক্ষাকালে ২৩ ধরনের ডিজিটাল দ্রব্যাদির দক্ষতা দেখার চেষ্টা করা হয়। এরমধ্যে প্রাথমিকভাবে চার ধরনের ব্যবহারের সঙ্গে তাদের পরিচিতির তথ্য পাওয়া গেছে।
অবশ্য এতসবের মধ্যে যারা ডিজিটাল সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছেন তারা যথেষ্ট সুফল পাচ্ছেন। সম্পূর্ণ ডিজিটাল এবং হাইব্রিড গণমাধ্যম (যেসব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সনাতনী এবং ডিজিটাল মাধ্যমের সংমিশ্রণে পরিচালিত হচ্ছে) সনাতনী সাংবাদিকতাকে উৎরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউরোশিয়ার দেশগুলো এগিয়ে (৫৫ শতাংশ)। তবে ডিজিটাইজেশনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মন্দগতি পরিলক্ষিত। আইসিএফজে বিশ্বকে আটটি অঞ্চলে ভাগ করে সমীক্ষাটি চালায়। এরমধ্যে একমাত্র দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো উত্তরাধিকার বা সনাতনী (লিগ্যাসি) গণমাধ্যম প্রভাব বিস্তার করে আছে। সেখানকার ৪৩ শতাংশ বার্তাকক্ষ এখনও সনাতনী ধাঁচের। সমীক্ষায় ভুয়া সংবাদ ও হ্যাকিংয়ের ব্যাপারে পূর্ব সতর্কতা, পাঠক ও দর্শকের বিশ্বাস-গ্রহণযোগ্যতা অর্জন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের আয়ের (রেভিনিউ) ও বিকল্প উৎস সৃষ্টি, সংবাদ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণী তথ্যের ব্যবহার ইত্যাদি বিভিন্ন দিক নিয়েও কাজ করেছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, সাংবাদিকতা তরুণশ্রেণির পেশা। ডিজিটাল বার্তাকক্ষের বেশির ভাগ কর্মীর বয়স ২৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। হাইব্রিড ও সনাতনী গণমাধ্যমের কর্মীদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ৫২ শতাংশ সাংবাদিক ডিজিটাল সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ চাইলেও ৪০ শতাংশ গণমাধ্যম অবশ্য এটা ব্যবস্থা করেছে।
বার্তাকক্ষের ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জও অনুসন্ধানের চেষ্টা দেখা গেছে সমীক্ষায়। নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে মোটাদাগে তিনটি উল্লেখ করা যায়। এগুলো হচ্ছে, আয়ের ধারা অব্যাহত রাখা, একনিষ্ঠ পাঠককুল এবং পাঠক-দর্শকের বিশ্বাসযোগ্যতা। বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে অবশ্য ইউরেশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার গণমাধ্যমের ভিন্ন অবস্থান আছে। ওইসব অঞ্চলের ৩০ শতাংশের কম মানুষের গণমাধ্যমের ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি আছে। তবে দক্ষিণ আমেরিকার চিত্র ভিন্ন। সেখানকার ৫০ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রধান ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

পাঁচ.
প্রায় দেড়দশক আগে শুরু হওয়া এই নয়া-বিপ্লবকে শোয়াব আলোচনায় তুলে আনলেও তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশিদূর এগোতে পারেনি। বলা যায়, বড়জোড় এর সূচনা পর্ব পার করেছে। ডিজিটাইজেশনের ফলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশাল পরিবর্তনের যে বাস্তবতার কথা ধারণা করা হচ্ছে, তার মধ্যগগণ বা অন্তিম কোথায়- তার আগাম পূর্বাভাস এখনই অসম্ভব বটে। তবে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, অর্থনীতি, জাতীয়-আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সার্বিক রাজনীতি, জাতীয় নিরাপত্তাসহ মানুষের জীবনের এই বিপ্লব ইতোমধ্যে বড়ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। তা ইতোমধ্যে ভয়াবহ গতির পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে- এমন বলাটা নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে মোটাদাগে আইসিএফজে গণমাধ্যম পরিস্থিতি চিহ্নিত করেছে তা উদ্বেগজনক বটে। সংস্থাটি নতুন বিপ্লবে গণমাধ্যমের অনুগামী হওয়ার উপযোগিতাকে এক শব্দে ‘অনুপযুক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আগামী দিনের গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য যে তিনটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার একটি (বিশ্বাসযোগ্যতা) অনেকদিন ধরেই আছে। গণমাধ্যমের আয়-উৎস নিয়েও চ্যালেঞ্জ আগে কম-বেশি ছিল। এসব নিয়েই গণমাধ্যম এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যে টেকনোলজিক্যাল অভিযোজনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে তার বাস্তবতায় আমাদের (বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার) প্রস্তুতি, আয়ত্ব আর প্রয়োগের অবস্থা কেমন? এছাড়া, তথ্য আর যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে একনিষ্ঠ পাঠক-দর্শক প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জও কম বড় নয়। ইতোমধ্যে মূলধারার গণমাধ্যমকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ। এটা কেবল এস্টাবলিশডমেন্টকে খুশি, রাজনৈতিক আদর্শ আর গণমাধ্যমের রেভিনিউ বা নিজের পলিসিগত কারণে অর্ধসত্য বা পুরো অসত্য সংবাদ প্রকাশ-প্রচারের বিচারে নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুজব আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য বিস্তারের বিরুদ্ধে নিজের সক্ষমতা প্রমাণের প্রয়োজনেও বটে। তবে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাইজেশন প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিক সাংবাদিক অথবা সবমিলে পেশা সাংবাদিকতার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হবে কতটা?

ছয়.
উপরের প্রশ্নগুলোর জবাব অনুসন্ধানে অবশ্যই কিছু বিষয়ে নজর দেয়া জরুরি। প্রথমত, পরিবর্তনের ধারায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি ৬ বছর আগে আইসিএফজের উল্লিখিত সমীক্ষায় যা চিহ্নিত হয়েছে, বর্তমানে যে তার উন্নতি খুব বেশি একটা হয়েছে- তা অবশ্যই বলা যাবে না। পত্রিকা অফিস বা টিভি-বেতার স্টেশন, রিপোর্টারের সংবাদ সংগ্রহ ও লিখন, তা প্রকাশ-প্রচারের ব্যবস্থা-প্রক্রিয়া, অর্থপ্রবাহ- এসবকে যদি এক শব্দে ‘সাংবাদিকতা’ শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করি, তাহলে বলা যাবে, তা (সাংবাদিকতা) নয়া পরিবর্তনের ধাক্কায় মুমূর্ষু অবস্থায় আছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। প্রথমত, অনেক কিছুরই অঘটন ঘটন পটিয়সী হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই মাধ্যমটি প্রথমে মূলধারার গণমাধ্যমের রেভিনিউতে ভাগ বসিয়েছে। ধীরে ধীরে যা গ্রাসই করে যাচ্ছে তা। এরপরে স্বেচ্ছা-অনিচ্ছায় বিশ্বাসযোগ্যতার যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা কেবল পাঠক-দর্শকের সংখ্যার বিচারেই নয়, উপার্জনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর দায়টা অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নয়, ‘সাংবাদিকতার’ নিজেরই। এরইমধ্যে বৈশ্বিক মহামারী করোনা কফিনে শেষ পেরেকটা মেরে দিয়েছে। তবে এর মধ্যে যে কারণে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি, সেটাই টানেলের শেষ মাথায় আলো দেখাচ্ছে। অর্থ্যাৎ, ডিজিটাইজেশনের সঙ্গে খাপখাওয়াতে গিয়ে সাংবাদিকতাকে ‘অনলাইন’ নামক ভার্সনকে ব্যাপক গুরুত্ব দিতে হয়েছে। এতে ক্লিক আর অনলাইন কেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন আয়ের বড় ‘হাব’ তৈরি হয়েছে। ফলে দৃশ্যমান আয় কমলেও অদৃশ্য আয় তৃষ্ণায় কাতর ব্যক্তির সামান্য হলেও পানির ব্যবস্থা করছে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বাসযোগ্য বা পুরো সত্যের ইস্যু না হয় বাদই দিলাম, অর্ধসত্য খবর তৈরির জন্যও রিপোর্টারকে তার বিটে যে অবগাহন করতে হয়, সেটা কতটা স্বস্তিদায়ক? একজন রিপোর্টার নানা উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এরমধ্যে দাফতরিক তথ্য সংগ্রহে তার যে চিরাচরিত পন্থা ও পদ্ধতি ছিল, গত কয়েকবছরে তার অনেক ক্ষেত্রেই মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে ইতোমধ্যে প্রায় শতভাগ অফিসে ই-নথি বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। ফলে ডাক-ফাইল আর হার্ডফাইল থেকে সমঝোতায় বা চুরিতে (!) ফটোকপি বা মোবাইল ফোনে ছবি তুলে নিয়ে ডকুমেন্ট সংগ্রহের পর প্রতিবেদন তৈরির কাজ বড়ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। এরমধ্যেই দফতরগুলোতে যুক্ত হয়েছে সিসিটিভি। ফলে নিম্নপদের বা উচ্চপদের কর্মচারীর থেকে তথ্য প্রাপ্তিও আরও দুরুহ হয়ে গেছে। এভাবে গতানুগতিক তথ্যসংগ্রহের প্রত্যেকটি দিক সম্পর্কে চ্যালেঞ্জের কথাগুলো বলা যাবে।

সাত.
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কী চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ‘সাংবাদিকতা’ বন্ধ করার ফরমান নিয়ে এসেছে? এ প্রসঙ্গে এখানে আমি বিশ্ববরেণ্য প-িত নোয়ামচমস্কিকে স্মরণ করতে চাই। আজ থেকে ৫৫বছর আগে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘বুদ্ধিজীবীর দায়’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ওহঃবষষবপঃঁধষং ধৎব রহ ধ ঢ়ড়ংরঃরড়হ ঃড় বীঢ়ড়ংব ঃযব ষরবং ড়ভ মড়াবৎহসবহঃং, ঃড় ধহধষুুব ধপঃরড়হং ধপপড়ৎফরহম ঃড় ঃযবরৎ পধঁংবং ধহফ সড়ঃরাবং ধহফ ড়ভঃবহ যরফফবহ রহঃবহঃরড়হং. ওহ ঃযব ডবংঃবৎহ ড়িৎষফ, ধঃ ষবধংঃ, ঃযবু যধাব ঃযব ঢ়ড়বিৎ ঃযধঃ পড়সবং ভৎড়স ঢ়ড়ষরঃরপধষ ষরনবৎঃু, ভৎড়স ধপপবংং ঃড় রহভড়ৎসধঃরড়হ ধহফ ভৎববফড়স ড়ভ বীঢ়ৎবংংরড়হ. এরমানে যদি এভাবে বলতে চাই যে, সরকারের মিথ্যা আর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সৎ-অসৎ উদ্দেশ্য প্রকাশ করা যদি গণমাধ্যমের কাজ হয়, সেটা কোনো সরকার বিশেষ করে হাইব্রিড আর কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের দেশগুলোর সরকার আদৌ দেবে কিনা বা সেটা কতটা সম্ভব তা প্রশ্নের অবকাশ রাখে। আর ইতোমধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে উদ্ভুত চ্যালেঞ্জগুলোকে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!

আট.
২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশের ক্লাবে যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। এর আগে সদস্য হতে চাই মাধ্যম আয়ের দেশের ক্লাবের। এজন্য অর্থনীতির প্রকৃত ইতিবাচক উল্লম্ফনের ব্যাপারে বলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি আরও অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসা জরুরি। শুধু গণমাধ্যমের কথা যদি বলি, তাহলে পশ্চিমাসভ্যতার মতোই গণমাধ্যমকে কাজে স্বস্তি ও সুবিধা এবং প্রশিক্ষণের দিকগুলো সবার আগে উল্লেখ করতে হয়। দিতে হবে সরকারের কাজের কারণ ও উদ্দেশ্য তুলে এনে প্রকাশ ও বিশ্লেষণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা। তথ্যের প্রবেশাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে সমুন্নত করতে হবে। সমাজে অসৎ সুবিধাভোগীর সংখ্যা আর বাড়তে না দিয়ে তা সীমিত করা জরুরি। অত্যাবশ্যক গণমাধ্যম যেন ভ্রান্ত, বিকৃত আর অর্ধসত্য উপস্থাপনা থেকে দূরে থাকতে পারে, সেই অবকাশ দেয়া। সমাজে গণমাধ্যমের ব্যক্তি পর্যায় থেকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সুযোগ-সুবিধা এখনও আছে। নইলে দৈনিক যে খবর পড়ি আর দেখি তা হয়তো সম্ভব হতো না। এখন দরকার গণতান্ত্রিকভাবেই উপযোগবাদী ক্ষমতায়ন। তাহলেই চতুর্থ শিল্পবের অগ্রগতির সঙ্গে হবে সাংবাদিকতার স্বাচ্ছন্দ্যের যাত্রা।

লেখক : যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা) ও এডুকেশন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ইরাব) সাবেক সভাপতি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে