“সঠিক কাজটি করা”(doing the right things) আর “কাজটি সঠিকভাবে করা”(doing things right) এই দুইয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে পছন্দ করতে বললে ব্যবসায়ের ছাত্ররা, এমনকি নির্বাহীরাও দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যান। এখানে প্রথমটি কৌশল(strategy), আর দ্বিতীয়টি বাস্তবায়নের (implementation) সাথে সম্পর্কিত।কেউ মনে করেন সঠিক কাজটি করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আবার অনেকে মনে করেন কাজটি সঠিকভাবে করতে না পারলে সবকিছুই ভেস্তে যাবে। বহুনির্বাচনী প্রশ্নের কেবল মাত্র দু’টি উত্তর থাকলে প্রথমটি বেছে নেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া যায়। কারণ “সঠিক কাজটি করা” কার্যকরীতার (effectiveness) সাথে জড়িত, আর “কাজটি সঠিকভাবে করা” দক্ষতার (efficiency) সাথে সম্পৃক্ত। দক্ষতা সহজেই নকল বা অনুকরণ করা যায়। কিন্তু আপনি কোন্ কাজটি করবেন যেহেতু সেটা একান্তই আপনি গোপন রাখতে পারেন সে ক্ষেত্রে সহজে সেটি নকল হওয়ার সুযোগ থাকে না। এজন্য “সঠিক কাজটি করা” বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের যদি আরো একটি উত্তর থাকতো, “সঠিক কাজটি সঠিকভাবে করা” তাহলে সেটাই হতো সঠিক উত্তর। কোনো বিতর্কে না গিয়েও বাস্তবায়ন বা implementation অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এটা নির্দিধায় বলা যায়। সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্বাহীরা কৌশল প্রণয়নে বেশি সময় দিলেও মধ্যম এবং মাঠ পর্যায়ের নির্বাহীরা কৌশল বাস্তবায়নে বেশি সময় ব্যয় করেন। তবে উচ্চ পর্যায়ের নির্বাহীরা যখন কৌশল নির্ধারণ করেন সেক্ষেত্রেও এর বাস্তবায়নযোগ্যতা তাঁদের কৌশল নির্বাচনের বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। Implementation এর প্রতিশব্দ গুলোর(synonyms) প্রতি একবার খেয়াল করলেই তাৎপর্য অনুধাবন সহজ হবে। প্রতিশব্দগুলো হচ্ছে- accomplishment, achievement, commission, discharge, enactment, execution, fullfilment, performance, perpetration, prosecution, persuance ইত্যাদি।
ম্যাককিনসে এন্ড কোম্পানি (বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যবস্থাপনা পরামর্শক সংস্থা, ১৯২৬ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ও. ম্যাককিনসে কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এই কোম্পানিটিতে ২০১৯ সলে প্রায় ৩০ হাজার লোক কর্মরত ছিলেন) লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৌশল বাস্তবায়নের একটি ফ্রেমওয়ার্ক উন্নয়ন করেন যা জনপ্রিয় McKinsey 7- S ফ্রেমওয়ার্ক নামে পরিচিত। এই ফ্রেমওয়ার্কে দেখানো হয়েছে সফলতার জন্য ভালো কৌশলের সাথে আরো ছয়টি আবশ্যকীয় উপাদান থাকতে হবে। অর্থাৎ কৌশল হচ্ছে সফলতার সাত ভাগের এক ভাগ। এই ফ্রেমওয়ার্কের সবকটি উপাদানের আদ্যাক্ষর ‘এস'(S) হওয়ায়, এটাকে “7-S Framework” নাম দেয়া হয়। উপাদানগুলো হচ্ছে- কাঠামো(Structure), কৌশল(Strategy), পদ্ধতি(Systems), সমমনা বা শেয়ারড ভ্যালুজ(Shared values), স্টাফ(Staff), নৈপুণ্য(Skills), এবং স্টাইল(Style)। তালিকাভুক্ত উপাদানসমূহের মধ্যে প্রথম তিনটিকে বলা হয় হার্ডওয়ার, আর শেষের চারটিকে বলা হয় সফটওয়্যার। শেয়ারড ভ্যালুকে মাঝখানের একটি বৃত্তে রেখে এর উপরে হার্ডওয়্যারের এর তিনটি বৃত্ত এবং নিচে সফটওয়্যারের অপর তিনটি বৃত্ত স্থাপন করা হয়। কেউ কেউ মাঝখানে অবস্থিত শেয়ারড ভ্যালুকে হার্ডওয়ার এবং সফটওয়্যারের মিথস্ক্রিয়ায় সৃষ্ট মিশ্রন বলে মনে করেন। হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার বলা একান্তই রূপক অর্থে, এর দ্বারা বোঝানো হয় হার্ডওয়ার ছাড়া সফটওয়্যার চালানো যায় না, সফটওয়্যার ছাড়া হার্ডওয়ার কেবলই কিছু ধাতব খন্ড।
যে কোনো পরিকল্পনা, যার বিস্তৃত রূপকে বলা হয় কর্মসূচি, বাস্তবায়ন করতে গেলেই একটি সাংগঠনিক কাঠামো(structure) লাগবে। সংগঠন বলতেই কতগুলো মানুষকে একসাথে জড়ো হওয়াকে বুঝায় না। এর একটি কাঠামো থাকতে হয়। অনেকটা ভবনের পিলার এবং ভীমের মত , কোনটার উপর কোনটা এটা ঠিক করেই প্রকৌশলীরা ভবন নির্মাণ করেন। পুরো প্রকৌশল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংকে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলা হয়। ভবনের কাঠামোর মতোই সংগঠনের অবশ্যই একটি কাঠামো থাকতে হবে। কে অর্ডার করবেন, কে অর্ডার শুনবে, চেইন অব কমান্ড পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করতে হবে। কতগুলো লোক শাহবাগে দাঁড়িয়ে আছে, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে, কোন একক উদ্দেশ্য নেই, অতএব একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে কোন সংগঠন বলা যাবে। ধরা যাক, এরা সবাই এয়ারপোর্টের বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য এক হলেও দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে সংগঠন বলা যাবে না। কারণ এদের মধ্যে কে আগে গাড়িতে উঠবে, পরে কে উঠবে, একবারে সবার স্থান সংকুলান না হলে কে পরের বাসে আসবে , কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এদের নেতৃত্ব কে দেবে তাও ঠিক হয়নি। লোক জড়ো হলেও কোন সংগঠন বলা যাবে না, এমনকি কোন একটি নির্দিষ্ট অর্জনের জন্য তাঁরা একসাথে জড়ো হলেও। কাঠামো বিহীন জনতা কোন সংগঠন নয়, কেবলই ‘আমজনতা’। এক্ষেত্রে ১৯৮০ এর দশকের স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটা বিপ্লবের ব্যর্থতার কথা আমরা স্মরণ করতে পারি।
সংগঠনের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়, অর্থাৎ সংগঠনে কে কোন্ কাজ করবে? কার অধীনে কাজ করবে? কে দায়িত্ব নেবে? ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক করা হয় । উদাহরণস্বরূপ একটি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগকে কার্য, ক্রেতা, পণ্য, অঞ্চল, ব্যবসায় পরিমাণের ভিত্তিতে সংগঠিত করা যেতে পারে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে তাদের জনবলকে কার্যভিত্তিক বিভাজন করতে আগ্রহী হতে দেখা যায়। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার অফিসের জনবলকে ভর্তি, পরীক্ষা, বৃত্তি, হিসাব, অডিট, বাজেট, প্রকৌশল, সংস্থাপন, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, এস্টেট ইত্যাদি ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে বিভাগ, ডিন এবং হল অফিসতো আছেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ডকুমেন্টে নামের বানান সংশোধনের চক্রে যারা পড়েছেন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন কার্যভিত্তিক সংগঠনের ঝামেলাটা কি। ধরা যাক, মার্কশিটে আপনার নাম করণিক ভুলক্রমে ‘শাহিদুল হক’ এর জায়গায় ‘শহিদুল হক’ হয়ে গেল, যেটা আপনার পিতার নাম। । এটা সংশোধনের চেষ্টা শুরু করছেন। প্রথমে বলা হয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের মার্কশিট শাখার ৪০৮ নম্বর কক্ষ থেকে একটি নীল রঙের ফরম সংগ্রহ করে সেটা পূরণ করে বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও ডিনের স্বাক্ষরসহ ভর্তি শাখার ৩০২ নম্বর কক্ষে জমা দিতে হবে, আপনার ভর্তির ফরম এর সাথে নাম মিলিয়ে দেখা হবে। এর জন্য এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। তারপর যেতে হবে ২১৭ নং কক্ষে হিসাব শাখায়, সেখান থেকে বলে দিবে নাম সংশোধনের ফি বাবদ কত টাকা জমা দিতে হবে। ওখান থেকে ফর্ম এর উপর একটা সিল দিয়ে হাতে লিখে দিবে- ” বিবিধ খাত, নগদ জমা, ১৫ টাকা মাত্র, জনতা ব্যাংক, টিএসসি শাখা”। লম্বা লাইন, এক ঘন্টা পর যখন টাকা জমা দেয়ার জন্য সুযোগ পেয়ে ব্যাংকের কাউন্টার ফরম জমা দিবেন কাউন্টারের অপর পাশ থেকে ব্যাংকের লোকটি ফরম চেক করে হঠাৎ বলে উঠলো- “হল প্রাধ্যক্ষের স্বাক্ষর কোথায়?” যা আপনি খেয়াল করেননি। ফরম ফেরত এনে হলে জমা দিতে হবে । দুই দিন পর হল প্রভোস্ট এর স্বাক্ষরসহ ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে আবার ৪০৮ নম্বর কক্ষে জমা দিলে স্লিপের একাংশ রেখে আর এক অংশের উপর আপনার সংশোধিত মার্কশিট প্রাপ্তির সম্ভাব্য তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে। সেটা করতে মাস খানেকের মত সময় লাগতে পারে।
ব্যবসায় ক্ষেত্রেও কার্যভিত্তিক বিভাজনই বেশি দেখা যায়। নতুন ওয়াশিং মেশিন কিনে এনেছেন বিকেলে। সন্ধ্যায় কাপড় দিয়ে ওয়াশিংমেশিন স্টার্ট দিলেন, কয়েক মিনিট ঘুরেই সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যাশমেমো দেখে ডিলারের দোকানে কল করেছেন। “দুঃখিত এখন সাতটা বেজে গেছে, কাউন্টারে কাউকে পাওয়া যাবে না। ০৩৮৯৭৫৬৩২ নাম্বারে ফোনে আমাদের কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার বিভাগে ফোন করে দেখতে পারেন”। নির্দিষ্ট নম্বরে কয়েকবার চেষ্টার পর একজন ধরল । আপনার সমস্যা বলতেই সে বলল, “এখনতো সাতটার বেশি বেজে গেছে, আপনি বরং রোববার সকাল দশটায় টেলিফোন করেন। আজ তো বৃহস্পতিবার, শুক্র-শনিবার আমাদের বন্ধ”। ভেবে দেখুন আপনার ওয়াশিং মেশিনের ভিতরে কাপড়- পানি -সাবানা একাকার, “শতভাগ শুকিয়ে বেরোবে” বিক্রয়কর্মীর এমন কথা শুনে রাতের ঘুমানোর চাদরটাও ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে ছিলেন। (আপনার স্ত্রী আপনাকে একটানা বকে যাচ্ছে, “আগেই বলেছিলাম মার্কেটিংয়ের তুমি কিছুই বোঝনা। মিন্টুকে না জিজ্ঞেস করে তোমার ওয়াশিং মেশিন কেনা ঠিক হয়নি”। মিন্টু হচ্ছে আপনার শ্যালক, অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। আপনার স্ত্রীর ধারনা সে ওয়াশিং মেশিন সম্পর্কে ভাল বুঝে। এত দামি একটা জিনিস কেনার আগে তাঁর মতামত নেয়া উচিত ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। যেকোনো শপিং পণ্য কিনতে গেলেই আপনাকে অনেকের মতামত নিতে হবে। এটাই আমাদের কালচার। আপনার নিজের সন্তানের টনসিল অপারেশন করিয়ে দেখুন আপনার শাশুড়ি অথবা আপনার মাকে জিজ্ঞেস না করে। আপনার শাশুড়ি এবং মা আপনার বাসায় আসাই বন্ধ করে দিবেন। “আমার নাতির এত বড় একটা অপারেশন তোরা করাইলি! আমারে একটু জিগাইলিও না”। আপনার শাশুড়ির বক্তব্য হচ্ছে আপনার সন্তানের অপারেশনের আগে রেখাকে একটু জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল। রেখা হচ্ছে আপনার শ্যালিকা, মনোয়ারা হাসপাতালের ইন্টার্নী ডাক্তার।)
পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে “ক্রস-ফাংশন টিম” তৈরি করা। কার্যক্রম চালানোর জন্য পৃথক পৃথক টিম তৈরি করে দেয়া। প্রত্যেক টিমে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক থাকবে। একজন মার্কেটিং, একজন ফাইন্যান্সের, একজন প্রকৌশলের মোট তিন জনের একটি টিম করে দেয়া। এভাবে যতটি প্রয়োজন ততটি টিম করা হবে। তাঁরা এক একটি পৃথক ইউনিট হিসেবে কাজ করবে। মার্কেটিং এর লোক সম্ভাব্য ক্রেতাকে প্রকৃত ক্রেতায় রূপান্তর করে দোকান পর্যন্ত নিয়ে আসবে। ফাইন্যান্সের লোক আর্থিক লেনদেন, কিস্তি, ঋণ ইত্যাদি ব্যবস্থা করবে। প্রকৌশলী ওয়াশিং মেশিন স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। প্রত্যেক কাস্টমার একটি টিমের কাছে তার প্রয়োজনীয় সব সেবা পাবে। যার নাম হচ্ছে “ওয়ান স্টপ সার্ভিস” । টিম সদস্য একজন কোন কারনে উপস্থিত না হলে এক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়। এর আরেকটি ভালো বিকল্প হচ্ছে বহু কাজ করতে সক্ষম এমন ব্যক্তিদের কোম্পানিতে নিয়োগ দেয়া। আজকাল বিজ্ঞাপনে দেখা যায় “প্রার্থীর অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স এন্ড ইলেকট্রনিক্সে স্নাতক, মার্কেটিং এবং ফাইন্যান্সে মেজর সহ এমবিএ থাকিতে হইবে। প্রার্থীকে সাঁতারকাটা, নৌকা এবং মোটর সাইকেল চালনায় পারদর্শী হইতে হইবে”। এই ধরনের যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীর এখন বাজারে অভাব নেই । এদেরকে বলা হয় মাল্টিপ্রফেশনাল(multi professional person)। ওয়াশিং মেশিনের কোম্পানি ওই একজনকে দিয়ে কাস্টমার ধরা, টাকা-পয়সার লেনদেন ইত্যাদির ব্যবস্থা এবং ওয়াশিং মেশিনের কোন সমস্যা দেখা দিলে মোটরসাইকেলে (ভাটি অঞ্চলে নৌকায়) কাস্টোমারের বাড়িতে গিয়ে ওয়াশিং মেশিন চালু করে দেয়া পর্যন্ত সবকিছু করাতে পারবে। আজকাল বেশিরভাগ কোম্পানি তাঁদের কর্মী নিয়োগের সময় মাল্টিপ্রফেশনাল ব্যক্তিদের গুরুত্ব দিচ্ছে।…(চলবে)
ড. মীজানুর রহমান, অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়