ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার অন্যতম ধাপ হচ্ছে পরিকল্পনা প্রণয়ন। ভবিষ্যতে আপনি কি করবেন তার মানস ছবিকে পরিকল্পনা বলা হয় (planning is the mental picture of the future course of action)। পরিকল্পনা সব সময় কম্পিউটার কম্পোজ করে স্পাইরাল বাইন্ডিং করা নাও হতে পারে। মনে মনেও পরিকল্পনা করা যেতে পারে। আনুষ্ঠানিক লিখিত পরিকল্পনার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে পরিবেশের বর্ণনা। বর্তমান অবস্থার একটা বর্ণনা বা প্রেক্ষাপট পরিকল্পনায় থাকতেই হবে। বাজেটকে যদি আমরা সরকারের আগামী বছরের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা হিসেবে ধরি, তাহলেও দেখব অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা শুরুর অর্ধেকটা জুড়েই থাকে অর্থনীতির বর্তমান হালচাল। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে আগামী বছরের করণীয় নির্ধারণ করা হয়।
পরিবর্তনশীল পরিবেশে সৃষ্ট সুযোগে এবং হুমকির সাথে সংগঠনের উদ্দেশ্য, নৈপুণ্য এবং সম্পদের টেকসই মিল তৈরি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে কৌশলগত পরিকল্পনা বলে (strategic planning is the managerial process of developing and maintaining a viable fit between the organisation’s objectives, skills, and resources and its changing opportunities and threats)। পরিস্থিতি বিশ্লেষণের উপরেই নির্ভর করে ভবিষ্যতের করণীয়। সমস্যা হচ্ছে, পরিবেশ দ্রুত বদলে যায়। যখন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় আর সেটা যখন বাস্তবায়ন করা হয় এই দুইয়ের মধ্যে সময়ের পার্থক্য তৈরী হয়। সেটা কয়েক মিনিট, ঘন্টা, দিন, মাস এমনকি কয়েক বছরও হতে পারে। আজকে যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন হচ্ছে এটার প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৯৬১ সালে, ১৯৬৩ সালে অনুমোদিত হয়। ১৯৬৮ সালে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৭২-৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর দেশকে আত্মনির্ভর করার তাঁর নেয়া অন্যান্য উদ্যোগের মত এই উদ্যোগটিও থেমে যায়। ১৩ মে ২০০৯ সালে রাশিয়ার ROSATOM এর সাথে বাংলাদেশের এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। ২০ নভেম্বর ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু হয়। যখন ভূমি অধিগ্রহণ করা হয় তখন পাশেই ছিল পদ্মা নদী, কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে পদ্মা নদী চলে গেছে কয়েক কিলোমিটার দূরে।
“Environment’ শব্দটাকে যদি একটা ক্রিয়াপদ(verb) হিসেবে কল্পনা করা হয়, তাহলে এর জন্য উপযুক্ত একটা কাল(tense) হচ্ছে ‘present perfect continuous tense’, যে কাজ অতীতে আরম্ভ হইয়া এখনো চলিতেছে। ‘Environment’ শব্দটির অদ্যাক্ষর ‘E’ লিখে শেষ অক্ষর ‘t’ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই এনভায়রনমেন্ট পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। আপনার পরিকল্পনা হয়ে যেতে পারে ‘unfit’। আপনার সম্পদ ও সামর্থ্য নতুন পরিবেশে সেকেলে হয়ে যেতে পারে। কোম্পানির সম্পদ এবং সামর্থ্যকে পরিবর্তিত অবস্থায় ফিট রাখার জন্য সামরিক বাহিনীর অভিধান থেকে কৌশলগত শব্দটি ব্যবসায় জগতে ধার করা হয়েছে । সামরিক বাহিনীর সকল পরিকল্পনাই কৌশলগত পরিকল্পনা । পরিবেশের বর্ণনা কৌশলগত পরিকল্পনারও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কিন্তু সেখানে অতিরিক্ত আরো কিছু প্যারা বা পৃষ্ঠা যুক্ত করা হয়। যেখানে বিদ্যমান পরিবেশে ভবিষ্যতে কি কি পরিবর্তন হতে পারে এবং সেই পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে করণীয় কি হতে পারে তার বর্ণনা থাকে। যার কারণে কৌশলগত পরিকল্পনা কখনো আনফিট হয়না। ধরা যাক, কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলা জেএমবি দখল করে নিয়েছে। সেখানে এখন চাঁদ-তারা ঝান্ডা উড়ছে এবং মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে। সরকার থেকে রংপুর সেনানিবাসের জিওসি কে বলা হল নাগেশ্বরী থেকে জেএমবি কে পরাস্ত করে ঝান্ডা নামিয়ে পতাকা উত্তোলন করতে। সভ্য দুনিয়ায় ঝান্ডার দিন শেষ হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী তখন জেএমবির হাত থেকে নাগেশ্বরী মুক্ত করার ছক তৈরি করে: “রাত দশটায় রংপুর সেনানিবাস হইতে যাত্রা শুরু করিয়া রাত ১১ টায় কুড়িগ্রাম শহর অতিক্রম, রাত ১১ টা ৫৫ মিনিটে ধরলা নদীর ব্রিজ অতিক্রম, এবং রাত ১২ টা ১ মিনিটে আক্রমণ।” কিন্তু ১১টা ৫৫ মিনিটে নদীর পাড়ে পৌঁছে দেখা গেল নদীর উপর ব্রিজটি জেএমবি আগেই ভেঙ্গে ফেলেছে ( জেএমবি লোকেরাও এখন রসায়ন পড়ে, তাদের সনাতনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সিলেবাসের আধুনিকায়ন করা হয়েছে; রসায়ন পড়ানো হচ্ছে) । ধরলা নদীর ব্রিজ ভাঙ্গার পরেও সেনা বাহিনী সময় মতোই আক্রমণ করবে। কারণ রংপুর থেকে রওনা হওয়ার সময়ই সেনাবাহিনী তাদের পদাতিক বাহিনীর সাথে আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরকে সাথে নিয়ে নিয়েছে, যাদের কাছে আগে থেকেই ধরলা নদী পার হওয়ার উপযুক্ত একটা জরুরী ব্রিজ বানানো আছে। তাৎক্ষণিকভাবেই তাঁরা একটি ভাসমান ব্রিজ তৈরি করে ফেলবে এবং তা দিয়ে সেনাবাহিনীর নদী পার হয়ে যাবে এবং সময় মতোই নাগেশ্বরী আক্রমণ এবং নাগেশ্বরী জেএমবি হাত থেকে মুক্ত করবে। নাগেশ্বরী পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় নদীর উপর ব্রিজটি ছিল, তা ‘বর্তমান পরিবেশ’। প্রতিপক্ষ ব্রিজটি ভেঙ্গে ফেলতে পারে সেটা হল ‘পরিবর্তিত পরিবেশ’। পরিবেশের বর্ণনায় সম্ভাব্য পরিবর্তনটি আমলে নিয়ে সেই প্রেক্ষিতে করণীয় নির্দিষ্ট করা ছিল বলেই সেই রাতে সেনাবাহিনী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েনি বা তাদের সম্পদ ও সামর্থ্য ‘আনফিট’ হয়ে যায়নি।
আরো একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে, সেটাও একটি সামরিক বাহিনীর উদাহরণ। ১৫ জুন ২০০১ সাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ, যা স্থানীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর মাজার নামে পরিচিত, তার উদ্বোধন অনুষ্ঠান। অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক অতিথি যার মধ্যে তিন বাহিনীর প্রধান, বিচারকবৃন্দ, মন্ত্রীবর্গ, সচিবগণ অন্যান্যরা প্রায় সবাই একই পর্যায়ের লোক। সৌভাগ্যক্রমে আমিও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। সমাধিসৌধে একটি এম্পিথিয়েটার আছে, সেখানে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। এই মাজার কমপ্লেক্সটি নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন আর্মি ইঞ্জিনীরিং কোর। (স্মরণ করা যেতে পারে, স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফলে সেনাবাহিনীর কিছু অবসরপ্রাপ্ত, চাকরীচ্যুত এবং বিপথগামী সদস্যের হাতেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন।) পুরো অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় ছিলেন আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, যিনি এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। তিনি প্রথমে দাঁড়িয়ে সবাইকে সম্বোধন করে বললেন, ” মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, … এই প্রকল্পটি … একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত, … সালে প্রথম শুরু হয়, কয়েকবার কাজ বন্ধ হয়ে যায়, এটার ২০০ মিটার লম্বা রাস্তা .. সামনে মসজিদ, ডানে…ইত্যাদি।” এরপরে বললেন, “আমি এখন একটি ম্যাপের সাহায্যে পুরো মাজার কমপ্লেক্সটি আপনাদের দেখাবো।” এই বলেই ব্রিগেডিয়ার সাহেব পকেট থেকে লেজার পয়েন্টার বের করে হাতে নিয়ে ম্যাপের দিকে ধরলেন। দুইবার চেষ্টার পরেও দেখা গেল লেজার পয়েন্টারটি জ্বলছে না। মুহুর্তের মধ্যে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মেজর ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে সামরিক কায়দায় সেলুট দিয়ে তাঁর হাতে নতুন একটা লেজার পয়েন্টার দিয়ে অকেজো পয়েন্টারটি ছো মেরে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় পয়েন্টারটি কাজ করলো। পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুততার সাথে ঘটল যে আমার ধারণা অডিয়েন্সের প্রায় কেউই বিষয়টি আন্দাজ করতে পারেনি। আমি যেহেতু মঞ্চের খুব কাছে বসে ছিলাম, বিষয়টা আমি দেখেছি। আরো লক্ষ্য করে দেখলাম অনতিদূরে একজন সিপাহী একটা লম্বা সাদা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ধারণা দ্বিতীয় লেজার পয়েন্টারটি কাজ না করলে ঐ লাঠি নিয়ে সে এগিয়ে আসতো, যা দিয়ে ব্রিগেডিয়ার সাহেব ম্যাপের নির্দিষ্ট স্থানগুলো অতিথিদেরকে দেখাতেন। পুরো ব্যাপারটা দেখে আমি ভাবছিলাম এই কাজ যদি গোপালগঞ্জের স্থানীয় প্রশাসনকে দেয়া হতো সেখানে একটি বিরাট হৈচৈ বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কেউ হয়তো বলে উঠতো “এনডিসি কোথায় গেছে? সে টাকা মেরে দিয়েছে, ভালো ব্যাটারি কিনেনি, … ইত্যাদি ইত্যাদি।” আসলে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কেউ একজন পূর্বেই বিষয়টি উল্লেখ করেছিল যে লেজার পয়েন্টারে কখনো কখনো নতুন ব্যাটারি লাগানোর সাথেসাথেই শর্ট সার্কিট হয়ে ব্যাটারি অকেজো হয়ে যেতে পারে। সেই জন্যেই তারা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ব্যাকআপ ব্যবস্থাটি রেখেছিল।
কৌশলগত পরিকল্পনা কেবলমাত্র সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত হয়, আর সেখান থেকে এনে এখন ব্যবসা-বাণিজ্য কর্পোরেট সেক্টরে এমবিএ পাস করা লোকদের দ্বারা তা অনুশীলন করা হয়, এমনটি নয় । আমি এমন ব্যক্তির কথা বলতে পারি যে কোনোদিন strategic শব্দটিও শোনেননি। কিন্তু সে একজন ভাল strategic প্লানার। পুরনো ঢাকার এক রিকশা গ্যারেজের মালিক। শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজ পাশেই তার রিক্সা গ্যারেজ। রিকশা গ্যারেজের মালিক হলেও হাজী সাহেব ব্রিটিশ আমলে ইংলিশ মিডিয়ামে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। ভালো ইংরেজি বলতে পারেন। এর মধ্যে কয়েকবার ওমরাহ, হজ ইত্যাদি করে একেবারে পাকাপোক্ত হাজী। ১৯৮৪ সালের দিকের ঘটনা। ইত্তেফাক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন, তাঁর গ্যারেজের জন্য “কতিপয় রিক্সা মিস্ত্রি আবশ্যক”। যাহারা মিস্ত্রি হতে আগ্রহী তাদেরকে সরাসরি একটা নির্দিষ্ট দিনে গ্যারেজে চলে আসতে বললেন। ওই নির্দিষ্ট দিনে হাজী চাচা তার সবচেয়ে ভালো পোশাক-আশাক পরে একটা হাতলওয়ালা চেয়ার নিয়ে গ্যারেজে গিয়ে বসলেন। ১৭ জন লোক এসেছিল গ্যারেজের মিস্ত্রী হওয়ার আগ্রহ নিয়ে। চাচা সবার ইন্টারভিউ নিলেন। তবে প্রত্যেকে একটিই প্রশ্ন করলেন, “বাবা, আমনে কি নৌকা বানাইতে পারেন?” উত্তর হচ্ছে, ” না চাচা, নৌকা তো বানাইতে পারি না”। “আচ্ছা ঠিক আছে, ওইখানে বাখরখানি আর চা আছে, খাইয়া যান।” তবে এর মধ্যে দুজনকে পাওয়া গেল যাদের বাড়ি চাঁদপুরের দিকে তাঁরা বলল, ” হ চাচা, নৌকাও বানাইতে পারি”। ওই দুজনকে আর কোন প্রশ্ন না করে সরাসরি রিকশা গ্যারেজের মিস্ত্রি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দিলেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত এভাবেই চললো।
১৯৮৮ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যায় পুরো ঢাকা শহর ডুবে গেল। প্রায় এক মাস পুরো ঢাকা শহর পানিতে অবরুদ্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ঢাকা শহরের একফোটা জায়গাও শুষ্ক ছিল না। মতিঝিলের শাপলা চত্বর ছিল প্রকৃতই শাপলা চত্বর, চারিদিকে অথৈ পানির মধ্যে শাপলাটি ভাসছিল। সোনালী ব্যাংকের গাড়ি-বারান্দার ছাদ পর্যন্ত পানি উঠেছিল। মান্ডা, বাড্ডা গুলশান, বনানী, শ্যামলী সবেই পানির নিচে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব “…আজকের চেষ্টা আমার” সঙ্গীত নিয়ে পানিতে হাঁটতে লাগলেন। জরুরী প্রয়োজনে মানুষকে বের হতে হয়। গাড়ি রিক্সা কিছুই চলছে না। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, ব্যাংকে আসতে হবে, ইত্যাদি কাজের জন্য প্রত্যেক বাড়িতে একটি করে ডিঙ্গি নৌকা জোগাড় শুরু হয়ে গেল। দুইশ-আড়াইশো টাকা দামের ডিঙ্গি নৌকা এক হাজার থেকে বারোশো টাকায় বিক্রি হতে লাগলো।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চাচা তাঁর রিক্সা গ্যারেজে ফ্লাসলাইট জ্বালিয়ে রাতদিন নৌকা বানানো শুরু করলেন। কারণ চাচা আগেই আশঙ্কা করেছিলেন ঢাকা শহরে একদিন পানিতে ডুবে যাবে। তখন রিকশা চলবে না, নৌকাই চলবে। চাচা একমাসেই গত কয়েক বছরের রিক্সা বানিয়ে যা আয় করেছেন তার চেয়ে বেশি আয় করে ফেললেন। শুধু তাই না, রিকশার গ্যারেজে নৌকা বানালে পুলিশ ঝামেলা করতে পারে। পুলিশ সবসময়ই কিছু একটা ফাঁকফোকর খুঁজে জরিমানা বা উপরি আদায়ের জন্য । আমি একবার বাসায় একটি আসবাব মেরামতের জন্য সামান্য একটু কাঠ কেনার জন্য মিস্ত্রিকে কাওরান বাজার পাঠিয়েছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটা অচেনা মোবাইল থেকে ফোন আসলো। আমি ফোন ধরলাম, জিজ্ঞেস করলাম, কে? “স্যার আমি আপনার কাঠমিস্ত্রি” কি হইছে? “স্যার আমারে শাহবাগে ট্রাফিক পুলিশে আটকাইয়া ফালাইছে”। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? ট্রাফিকের বক্তব্য কী? ” ট্রাফিক বলছে, মিশুক হইল যাত্রীবাহী পরিবহন। তুমি কাঠ কেন উঠাইছো?” আমি অন্যান্য বিড়ম্বনা পরিহারের জন্য তাঁকে একটা ব্যবস্থা করে চলে আসতে বললাম। কিছুক্ষণ পরে মিস্ত্রি চলে আসলো, মিশুকে করে কাঠ নিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যবস্থা করে আসলা? ” স্যার, কাঠ কিন্না ২০ টাকা বাচছিল, হেইডা ট্রাফিক ব্যাটারে দিয়া চইলা আইছি”। গ্যারেজ এর মালিক চাচার মনেও এই আশঙ্কা ছিল। পুলিশ জিজ্ঞেস করতে পারে, “তোমার গ্যারেজে হইল রিক্সার, নৌকা কেন বানাইলা? জরিমানা দাও।” সেজন্য চাচা ১৯৮১ সালে যখন মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নেন তখনই তার গ্যারেজের নাম রাখেন “আরবান ম্যানুয়াল ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড”। যার মধ্যে রিক্সা, ঠেলা, ভ্যান, নৌকা সবই অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, সাবেক উপাচার্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়