মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা একজন সাংবাদিক হেনরি গ্রুনওয়াল্ড বলেছেন,“journalism can never be silent : that is its greatest virtue and its greatest fault .It must speak, and speak immediately, while the echoes of wonder, the claims of triumph and the signs of horror are still in the air”
এটার বাংলা অনুবাদ অনেকটা এ রকম : “সাংবাদিকতা কখনো নীরব হতে পারে না। এটাই হচ্ছে এর সবচেয়ে বড়ো গুণ ও দোষও বটে। সাংবাদিকতাকে সশব্দ হতে হয় এবং বিস্ময়ের প্রতিধ্বনি, বিজয়ের দাবি ও ভয়ংকর চিহ্নগুলো বাতাসে ভাসতে থাকা অবস্থাতেই সাংবাদিকতাকে দ্রুত সোচ্চার হতে হয়।” এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বার্তা। এর ভেতর সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা এবং বড় বৈশিষ্ট ও গুণ নি:সন্দেহে প্রকাশ পেয়েছে।
শিক্ষা বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন এডুকেশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ( ইরাব ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠন। আমি তাদের কার্যনির্বাহী কমিটিসহ সংগঠনের সকল সদস্য ও শুভান্যুধায়ীকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই । সব সময় শুভ কামনা রইলো সংগঠনের সকল সম্মানিত সদস্যের জন্য।
বর্তমানে আমরা সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্বের চেয়ে দলীয় আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ বেশী করছি। যা জনমনে আমাদের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা যারা সাংবাদিকতা করি কেউই ব্যাক্তিগতভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে নই, কিন্ত যখন সাংবাদিকতা করি তখন পেশাদারিত্ব ও বস্তুনিষ্ঠতার প্রশ্নে আপসহীন থাকতে হয় ।এটা খুব সিরিয়াসলি আমাদের প্রতিপালন করা উচিত বলে মনে করি।
নিংসন্দেহে সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা এবং দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে সাংবাদিকতার বড় ভূমিকাও অনস্বীকার্য। আপনারা জানেন, একজন সাংবাদিককে তার পেশার মহত্বের কারণে সরকার বা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে হরহামেশা প্রবেশগাম্যতার সুযোগ রয়েছে। যখন সমাজের নির্যাতিত একজন মানুষ তার বিচার পাওয়ার প্রথামিক যে জায়গা সেখানে যেতে সাহস না পেলেও অন্তত তার সমস্যার কথা বলতে একজন সাংবাদিকের কাছে যেতে সাহস পান। একজন সাংবাদিকের কাছে তার বা তাদের সমস্যা বলতে পারেন এবং সাংবাদিক তা শুনে বস্তুনিষ্ঠভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরে সমাজের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ করে দেন । এটাই সাংবাদিকতার মূলকথা ও মর্মবাণী।
আমরা যদি লক্ষ্য করি, সাংবাদিকতায় গণমাধ্যমের মালিকের অবাধ স্বাধীনতা থাকলেও, রিপোর্টার বা সাংবাদিকের স্বাধীনতা প্রকৃতপক্ষে খুবই কম। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় গণমাধ্যমে মালিকের স্বার্থের কোনো প্রশ্ন আসলে নিউজ প্রকাশ হয়-অথবা হয় না। এটাই দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পরে এসেও আমাদের সামনে মহা এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যা আমাদের বহুলাংশে বেদনাক্লিষ্ট করে চলেছে।
গণমাধ্যমের মালিক বা মালিক গোষ্ঠী তাদের গণমাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে পছন্দমতো কিছু নীতি ঠিক করে কাজ পরিচালনা করে। সেই নীতির আলোকেই প্রতিটি গনমাধ্যম পরিচালিত হয়। গণমাধ্যমে কর্মরত সব সাংবাদিক সেই নীতি অনুসরণ করেই কাজ করে থাকেন । এটা মোটামুটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পথ।
প্রয়াত গণমাধ্যম বিশ্লেষক মুহম্মদ জাহাঙ্গীর তার সুলিখিত এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘প্রত্যেক গণমাধ্যমের একটা নৈতিকতা থাকে। ইংরেজিতে যাকে বলে এথিকস। গণমাধ্যমের নীতি যাই হোক না কেন, এথিকস তাকে মেনে চলতেই হবে। এটাও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একটি গণমাধ্যম একজন বা একাধিক ব্যাক্তির অর্থ বিনিয়োগে পরিচালিত হলেও গণমাধ্যমের মালিক বা পরিচালক, যা খুশি তা করতে পারেন না । যে দেশের গণমাধ্যম সেই দেশের সাধারণ মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদির আলোকে গণ্যমাধ্যমের নৈতিকতা নির্ভরশীল । এই এথিকস পৃথিবীর সব দেশে একরকম নয়। বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধ দ্বারা তা পরিবর্তিত হতে পারে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবে। বিকিনি পরা একজন মহিলার ছবি বিলাতের কাগজে বড় করে ছাপা হলে তা দোষণীয় হবে না। কিন্ত বাংলাদেশের খবরের কাগজে বা টিভিতে তা প্রায় অসম্ভব কাজ। বিষয়টা এরকম।
এবার একটি অন্য প্রসঙ্গে আসি, গণমাধ্যমের একটি স্বাভাবিক কাজ হলো, বিভিন্ন সংবাদে সংক্ষুদ্ধ ব্যাক্তি প্রেরিত প্রতিবাদ ছাপানো। অনেক সময় নানা কারণে সংবাদপত্রে ভুল তথ্য প্রকাশিত হয়। তখন যার সম্পর্কে লেখা তিনি বা তারা অফিসে প্রতিবাদ করেন। সেই প্রতিবাদপত্রও সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করতে হয়। সংবাদপত্র তথা রিপোর্টারের নিজস্ব বক্তব্য থাকলে প্রতিবাদপত্রের সঙ্গে তা যুক্ত করা যায়। কিন্ত প্রকাশিত রিপোর্টের প্রতিবাদ পাঠানো হলে তা প্রকাশ করতেই হবে। এ ব্যাপারে সংবাদপত্রের কোনো অজুহাত ধোপে টিকবে না। কিন্তু আজকাল দেখা যায়, অনেক সংবাদপত্রে, এমনকি বহুল প্রচারিত খ্যাত পত্রপত্রিকাতেও ‘প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি’ প্রকাশ করা হয় না। এজন্য সম্পাদক অবশ্যই দায়ী। অভিযুক্ত ব্যাক্তি যদি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করেন, তাহলে সেই সম্পাদকের শাস্তি হতে পারে।
কেনো ব্যাক্তি সম্পর্কে রাজনৈতিক, আর্থিক, আয়কর বা অন্যান্য বিষয়ে অভিযোগ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হলে সেই অভিযুক্ত ব্যাক্তির বক্তব্য অবশ্যই রিপোর্টের সঙ্গে থাকতে হবে। ওই ব্যাক্তির বক্তব্য ছাড়া সংবাদ প্রকাশ হতে পারে না। কিন্ত ঢাকার বহু প্রত্রিকা অভিযুক্ত ব্যাক্তির বক্তব্য ছাড়াই প্রায়শ বিভিন্ন অভিযোগ সংবলিত খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যেটা সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতার বড় ঘাটতি বলে মনে করি। এসব বিষয়ে আমাদের আরও সজাগ ও সচেতন হওয়া উচিত। সাংবাদিকতায় সাধারণ নীতিনৈতিকতা মেনে চলা উচিত।
মুরসালিন নোমানী: সভাপতি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ( ডিআরইউ), সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)। কৃতজ্ঞতা : কলম।