গত কয়েক বছরে দেশের শিক্ষা খাতে অনেক ভালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্ত তা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা ভালো শিক্ষকের সংকট । যত বড় পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক না কেন, এর জন্য প্রথম দরকার ভালো শিক্ষক। আগে তা ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই যে কোনো পরিবর্তন বাস্তবিক অর্থে কাজে আসবে।
দেশের শিক্ষার মানে যে উন্নতি ঘটছে না, সেটা বাস্তবিক সত্য। গত কয়েক দশকে শিক্ষার আকার যেভাবে বেড়েছে, গুনগত মান সেভাবে বাড়েনি। অল্পকিছু শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে যারা ভালো মানের । আগের তুলনাতেও উচ্চ মানের। কিন্ত, গড়পড়তা শিক্ষার্থীর জ্ঞান বাড়ছে না। আসলে শিক্ষার মান অনেকাংশেই নির্ভর করে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের ওপর। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের আগে এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের সনদ নিতে হয়। শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহন অত্যাবশ্যক। তাই আমাদের দেশেও নিয়োগের শর্ত হিসেবে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক হওয়াও জরুরি। কেননা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন করা যাবে না।
এছাড়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় সমস্যা হলো শ্রেণি বিভাজন। শিক্ষার পরিধি যত বাড়ছে, বৈষম্য তত বাড়ছে। এটা নানা জায়গায় নানাভাবে রয়েছে। যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে , তাদের লক্ষ্য থাকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। কেননা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সুবিধা করতে পারে না। ওখান থেকে তারা টাকার জোরে বিদেশে চলে যাবে। তারপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আর দেশে ফিরবে না। তার মানে মেধা পাচার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিত্তবানের ঘরের ছেলেমেয়েরাই অধিক সুযোগ পাচ্ছে। এদিকে বাংলার যে মূলধারা, সেই মূলধারা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। যেমন- ইতিহাসের চর্চা শিক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আমরা যারা ব্রিটিশ আমলে বড় হয়েছি, তারা ভারতবর্ষের ইতিহাস যেমন পড়তাম, তেমনি ইংরেজদের ইতিহাসও পড়তাম। এখন ইতিহাসকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এছাড়া মূল ধারার বাইরে ধর্মীয় শিক্ষায়ও অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি হচ্ছে।
শহরে সুযোগ বেশি, গ্রামে কম –এখানে বড় বিভাজন। যারা সুযোগ পাচ্ছে, তারাই শহরে আসছে। আর শহরে যারা গরিব, তারা আবার ভালো ফল করতে পারে না। শিক্ষা এখন পণ্য হয়ে গেছে। তারাই শিক্ষিত হচ্ছে, যারা শিক্ষা কিনতে পারছে। একসময় একটা শহরে সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল সরকারি স্কুল। প্রাইভেট স্কুল থাকলেও মানুষ প্রথমে তাদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে দেওয়ার চেষ্টা করত। না পেলে প্রাইভেট স্কুলে দিত। এখন প্রাইভেট স্কুলই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি স্কুলগুলো সংখ্যায় বাড়েনি। তাদের মান উন্নত করা যেত। সেটাও হয়নি । এখন পাবলিক স্কুল–কলেজে পড়াশোনা হয় না, শিক্ষার্থীদের যেতে হয় কোচিং সেন্টারে। আর সেখানে যাওয়া মানেই হচ্ছে শিক্ষা কেনা। শিক্ষার্থীরা টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনছে , পরীক্ষায় ভালো ফল কেনার চেষ্টা করছে। চিকিৎসা যেমন করে কিনতে হচ্ছে, শিক্ষাও সেভাবে আমাদের কিনতে হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা। আজকের পুঁজিবাদী বিশ্ব তা করেও । কিন্তু আমাদের এই নিষ্ঠুর, ভয়ংকর পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করছে না । এখানে সব লোককে চিকিৎসার জন্য যেমন নিজের ওপর নির্ভর করতে হয়, তেমনি শিক্ষার জন্যও নিজের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে যারা পারছে তারা শিক্ষা ক্রয় করছে, যারা পারছে না তারা শিক্ষা নিতে পারছে না।
শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি দুর্বলতা হলো পরীক্ষাকেন্দ্রীকতা। আমাদের দেশের সব শিক্ষা সংস্কার পরীক্ষার সঙ্গে জরিত। ক্লাসরুমে পড়ানো হচ্ছে কি না সেটার দিকে না তাকিয়ে পরীক্ষার নতুন ব্যবস্থা, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা ঠিকমতো হচ্ছে কি না দেখা, কত শতাংশ ছেলেমেয়ে পাস করল, সেটা নিয়ে প্রচারে সবাই ব্যস্ত থাকছে। পুরনো পরীক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা না করে পরীক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আরও গভীরভাবে ঢোকা হচ্ছে, যা খুবই ক্ষতিকর । অথচ ইংরেজি মাধ্যমে এত পাবলিক পরীক্ষা নেই। ওখানে সিলেবাসও পরিবর্তন হয়না । তারা ও- লেভেল, এ- লেভেল পরীক্ষা দিচ্ছে। আর কোনো পাবলিক পরীক্ষা নেই।
আমদের মতো জনবহুল দেশে শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার। এর মাধ্যমে আমরা দক্ষ মানুষ তৈরি করব। এই দক্ষ মানুষরা উন্নয়নের কাজে লাগবে। অর্থনীতির উন্নয়নটাও সেভাবে হবে। আমাদের সম্পদ সীমিত। কাজেই সেই সীমিত সম্পদের মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত করা আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। মেধাবান শিক্ষকদের এই পেশায় আনতে হলে তাদের বেতন–ভাতা অন্য পেশা থেকে স্বতন্ত্র করতে হবে। সেটা করতে হলে রাষ্ট্রীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ থাকা উচিত শিক্ষাক্ষেত্রে। এটাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য প্রথমত, অনুৎপাদক খাতে ব্যয় কমিয়ে এই উৎপাদন খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে; দ্বিতীয়ত, শিক্ষকরা যাতে পড়ান সে জন্য জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, নজরদারিত্ব বাড়াতে হবে। সরকারি নজরদারিত্ব মানেই নানারকম ফাঁকফোকর। তাই সামাজিকভাবে এই দায়িত্ব বাড়াতে হবে। অর্থাৎ অভিভাবকরাই দেখবেন ছেলেমেয়েদের ক্লাসরুমে ঠিকমতো পড়াশোনা হচ্ছে কি না। কারণ ওটাই পড়াশোনার আসল জায়গা। শুধু পুঁথিগত পড়াশোনায় আবদ্ধ না রেখে ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিকভাবেও প্রস্তুত করতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বরেণ্য শিক্ষাবিদ। ইমিরেটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কৃতজ্ঞতা : কলম