Education is the most powerful weapon that we can use to change the world. এই আপ্তবাক্যকে মেনে নিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী মাত্র কয়েকবছরে বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছিলেন উপনিবেশিক শাসনামলে প্রবর্তিত পূর্ববাংলার বঞ্চিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তব্য, নীতি ও কর্মকা-ের মাধ্যমে শিক্ষা বিষয়ে তার চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন তথ্য, দলিল ও প্রকাশনা পর্যালোচনা করে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়।শিক্ষাক্ষেত্রে তার ছিল একটি স্বতন্ত্র দর্শন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, সংবিধানে শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক, শিক্ষা কমিশন গঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্বশাসন প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয় মজ্ঞুরী কমিশন গঠন সহ নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেন। যাকে বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধুর ‘শিক্ষা দর্শন’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ঃ একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। ১৯৫২ সালে যখন পাকিস্তানিরা আমাদের মাতৃভাষার ওপর আঘাত হানল তখনই বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা না হলে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। জাতি মেরুদ-হীন হয়ে পড়বে। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময়েও তিনি কার্যকরী সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে। এই ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন।
প্রথমত-সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত- নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্যে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করা
তৃতীয়ত- উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য যেন মেধাবীদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
বঙ্গবন্ধুর তিন প্রস্তাবই শিক্ষার ক্ষেত্রে এক অমূল্য দর্শন। ক্ষমতায় যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তার এই ভাষণের বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর পাকিস্থান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে হতাশ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ চট্টগ্রামে শিক্ষক ও লেখকদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় অনুশোচনা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই শিক্ষা ব্যবস্থঅ মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিকশিত মানুষ সৃষ্টির পরিবর্তে শুধু আমলা তৈরি করছে। প্রামীন মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়অর জন্য প্রত্যেক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কিছুদিন গ্রামাঞ্চলে কাটানোর পরামর্শ দেন তিনি।

শিক্ষার অগ্রযাত্রায় গৃহীত পদক্ষেপ ঃ
রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে পরিবর্তন আনেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, কারিগরি সব জায়গায় আধুনিক ও মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন তবে আমূল পরিবর্তনটা তিনি এনেছিলেন প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায়। এরও একটা আলাদা দর্শন রয়েছে। কারণ ৭০ এর নির্বাচনী ভাষণ ও প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু নিরক্ষরমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য তিনি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিতরণের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষাকে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব। প-িত জওহরলাল নেহেরুর মতে, একটি দেশ ভালো হয় যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভালো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলো জাতির থিঙ্ক ট্যাংক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যত উচ্চ গবেষণা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা হবে দেশ তত উন্নত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই মূলত দেশের প্রতিচ্ছবি। পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেহাল দশা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না কোনো স্বায়ত্ত্বশাসন। উচ্চ শিক্ষা ছিল ধনীদের পণ্য। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় এসে উচ্চশিক্ষার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন এবং ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করলেন এবং গঠন করলেন মঞ্জুরি কমিশন।

সংবিধানে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান ঃ
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনার জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেন তাতেও তিনি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে শিক্ষার বিষয়টি উল্লেখ আছে। সংবিধানের ১৭(ক) ত বলা হয়েছে – একই পদ্ধতির গণমুখি ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে তত্বাবধান করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রনোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ ঃ
বঙ্গবন্ধু দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বিস্তার ও নিরক্ষর মুক্ত দেশ গড়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের একটি আইন প্রণয়ন করেন যা The Primary Schools (Taking Over) Act ১৯৭৪ নামে পরিচিত। আইনটিতে ৭টি ধারা রয়েছে। আইনটির তৃতীয় ধারায় বর্ণিত আছে-
ধ) সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং তার সব সম্পদ – ভূমি, ভবন, সকল রেকর্ড, ডকুমেন্ট সরকারের কাছে স্থানান্তরিত হবে এবং ন্যস্ত থাকবে।
ন) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক সরকারি কর্মচারী হবে এবং তারা সরকারি সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে।

এই আইন প্রণয়নের পর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করে শিক্ষাকে সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া তার আমল থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হত। বিতরন করা হত বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ (খাতা, কলম পেন্সিল) ইত্যাদি।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৪৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও চাকরি সরকারিকরণ, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই ও গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পোষাক প্রদান করেন।

প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭০-৭৮) এ শিক্ষার বরাদ্দ ছিল সবচেয়ে বেশি। টাকার অংকে তা ছিল মোট বাজেটের ৭% । বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীন দেশে প্রথম যে বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তাতে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেশি ছিল।
কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন প্রতিরক্ষা খাত দিয়ে নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়া যাবে না কিন্তু শিক্ষা খাতে বেশি বরাদ্দ রাখলেই দেশকে নিরক্ষরমুক্ত আলোকিত সোনার বাংলা গড়া যাবে।

উচ্চ শিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান ঃ
উচ্চশিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অপরিসীম। পূর্বেই বলা হয়েছে পাকিস্তান আমলে উচ্চশিক্ষার মান ভালো ছিল না। গরিব মেধাবীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না কোনো স্বায়ত্ত্বশাসন। কোনো যুগোপযুগী শিক্ষা কমিশনও ছিল না। এজন্য আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেছিল। ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বঙ্গবন্ধুর উচ্চশিক্ষার অবদানকে তিনটি ক্ষেত্রে বিভক্ত করা যায়। যেমনÑ
র) বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন।
রর) বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান।
ররর) একটি কার্যকরী শিক্ষা কমিশন গঠন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন ঃ
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন প্রণয়ন করেছিলেন। আইনটির মোট ১৫ টি ধারা ছিল। আইনের পঞ্চম ধারায় বলা হয়েছে
ধ) শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা নিরূপণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন।
ন) আর্থিক চাহিদা নির্ধারণ।
প) সরকারের ফান্ড গ্রহণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য তা বণ্টন।
ফ) বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন সকল বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও প্রোগ্রাম এর মূল্যায়ন।
ব) বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা মূল্যায়ন।
ভ) বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সকল পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহ।
ম) নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে পরামর্শ।

বিশ্ববিদ্যালয় সায়ত্বশাসন ঃ ১৯৭৩ সালের শুরুতে তৎকালীন আইন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের জন্য গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষকদের কাছে মতামত চান। এসব মতামতের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্ত্বশাসন, সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্র- শিক্ষক, কর্মকর্তা -কর্মচারী সবাইকে গণতান্ত্রিক মতামত রাখার সুযোগ প্রদান, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশের বিষয়টি উঠে আসে। এসব প্রস্তাব পাওয়ার পর ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দ্রুত সায়ত্বশাসন দিয়ে আইন জারি করা হয়। শিক্ষক ছাত্রদের দীর্ঘদিনের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে আইনগুলোতে।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ফলে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। আগে একটি ডিপার্টমেন্টের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক অবসরের আগ পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। এর ফলে নতুন শিক্ষকরা সুযোগ কম পেতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সত্যিকার অর্থে জ্ঞান চর্চার তীর্থভূমি এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠে।

শিক্ষা কমিশন গঠন ঃ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদাকে সভাপতি করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। সেই কমিটিকে বঙ্গবন্ধু দেশের শিক্ষার সামগ্রিক পরিস্থিতি জানা এবং শিক্ষা সম্পর্কে জনগণের মতামত জানার প্রতি গুরুত্বারোপের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী কমিশন জনগণের কাছ থেকে শিক্ষার বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো ও তাদের সুচিন্তিত মতামত আহ্বান করেন। সেই সবকিছু বিশ্লেষণ করে কমিশন ১৯৭৩ সালের ৮ জুন অন্তবর্তীকালীন রিপোর্ট এবং ১৯৭৪ সালের মে মাসে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করেন। এই রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের বেশির ভাগই প্রতিফলিত হয়েছিল। কমিশন শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, নারী শিক্ষার প্রসার, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ, শিক্ষার সকলক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যম প্রবর্তনসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করে। এই সুপারিশগুলো করা হয়েছিল জাতীয় আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে। এই কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা দর্শনের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুষ্পষ্ট বোধ শিক্ষার্থীদের চিত্তে জাগ্রত করে তাদেরকে সুনাগরিক রূপে গড়ে তোলাই ছিল বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন তথা কুদরতে-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের মুল রূপকল্প।

কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের যে সব বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল তাহলো ঃ-
১. প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা।
২. মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে সুসমন্বিত কল্যান ধর্মী ব্যক্তিজীবন ও সমাজ জীবনের জন্য সচেতন কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ, সৎও প্রগতিশীল জীবন বোধ সম্পন্ন ব্যাক্তিত্বের বিকাশ সাধন করা।
৩. দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রয়াসে প্রয়োজনীয় মধ্যম স্তরের কর্মকুশল দক্ষ ও কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মী সরবরাহ করা।
৪. মেধা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদেরকে উচ্চ শিক্ষার উপযোগী করে গড়ে তোলা।
৫. প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার স্তরকে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে উন্নিত করা।
বিজ্ঞান্, কৃষি, চিকিৎসা, বাণিজ্য, আইন, ললিতকলা/চারুকলা প্রভৃতি শিক্ষার জন্য আলাদা আলাদা ভাবে বিস্তৃত পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন ড. কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিশন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বিশ্বের সাথে সমন্বয় সাধন করে বাঙালি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য যাতে অগ্রসর হতে পারে সে বিষয়েও কমিশন বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন। তাছাড়া এই কমিশনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গণমূখী শিক্ষা কিংবা সার্বজনীন শিক্ষা।

কমিশনের প্রধান পর্যবেক্ষণ গুলোর মধ্যে যেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো হলো- শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকর্ষিত করা, শিক্ষকদের জন্য ভালো পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা, শিক্ষার সব পর্যায়ে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ, ইংরেজি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আর্ন্তজাতিক ভঅষা শেখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, কারিগরী ও অন্যান্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়া, শিক্ষঅ ও গবেষনার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে উচ্চ শিক্ষঅ ব্যবস্থাকে গড়ে তোলা, জাতীয় উন্নয়নের জন্য ফলিত গবেষনার উপর জোর দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করা, সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষাকে একটি বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা। এই কমিশন আরো সুপারিশ করেছে যে, প্রতিবছর জাতীয় আয়ের শতকরা ৫ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা ৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাবও দেওয়া হয় এই প্রতিবেদনে।

বৃত্তিমূলক ও কারিগরী শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ ঃ বৃত্তিমুলক অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলা হয় যে- বৃত্তিমুলক শিক্ষার ভিত্তি রচিত হবে মাধ্যমিক স্তরে। দশম শ্রেণীর পর বৃত্তিমুলক শিক্ষাক্রমের শিক্ষার্থীরা প্রয়োজন মতো উচ্চ পর্যায়ে বৃত্তিমুলক শিক্ষায় পারদর্শিতা লাভ করে দক্ষ কর্মী হিসাবে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করবে।

বঙ্গবন্ধু সবসময়ই শিক্ষাকে গণমুখী করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গণমুখী শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়। এজন্যই ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়া সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে তার নির্দেশনায় একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এবং আইনের দ্বারা র্নির্ধারিত পর্যাপ্ত বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা পাঠদানের বিষয়টি আবির্ভুত করা হয়। তিনি বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন জনগণকে। তার দেখানো পথ ধরেই আজকে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় টেকনিক্যাল, পলিটেকনিক্যাল, মহিলা পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে পাশ করা দক্ষ মানবসম্পদ দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায়ও তিনি শিক্ষকদের যুক্ত করেছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনে ড. নূরুল ইসলাম, প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান, ড. মোশাররফ হোসেন সহ অসংখ্য শিক্ষক, প্রকৌশলী ও পেশাজীবীকে যুক্ত করেছিলেন। প্রফেসর কবীর চৌধুরীকে তিনি শিক্ষা সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও ড. এ আর মল্লিককে মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন। সাহিত্যিক আবুল ফজলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য করেছিলেন। জয়নুল আবেদিনসহ সব শিল্পী ও শিক্ষাবিদকে তিনি শিক্ষকতুল্য সম্মান করতেন এবং তাদের উপদেশ শুনতেন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন Visionary Leader, শিক্ষা ছাড়া যে একটি জাতি মুক্তি পেতে পারে না এই সত্যটি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বলেই সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি দেশে সংবিধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রেই শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার দর্শনেই নির্মিত হয়েছে আধুনিক বাংলাদেশের শিক্ষার ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।’ তাইতো বলতে হয় “শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ”।

লেখক: মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ
সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে