বাংলা ট্রিবিউনে খবরটি দেখে চমকে উঠলাম বুধবার (১৯ মে, ২০২১) রাতে। দৈনিক জনকন্ঠ এর উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানকে নাকি চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছেন গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুর রহমান। তাঁর মতো একজন কিংবদন্তি তুল্য সম্পাদকের নাম জনকণ্ঠের প্রিন্টার্স লাইনে থাকার ওজন কতটা– তা বোঝার মতো কোনও লোক সত্যিকার অর্থেই হয়তো গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারে এখন আর অবশিষ্ট নেই।
তোয়াব খান এ দেশের সম্পাদকদের সম্পাদক। জনকণ্ঠ যে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত একটি শ্রেষ্ঠ প্রগতিশীল দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছিল, সেটা সম্ভব হয়েছিল শুধু ওই অনন্য কারিগর ব্যক্তির নেতৃত্বের কারণেই। ১৯৯৩ সালে সম্পাদক-প্রকাশক বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকুল্লাহ খান মাসুদ সাহেব সরল শিশুর মতো বিনা বাক্যব্যয়ে একটি উন্নত দৈনিকের জন্য তোয়াব খানের প্রতিটি পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন, আর তিনি একটি অসাধারণ দৈনিক জন্ম দিয়েছিলেন। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষ্য আমরা অনেকে এখনও জীবিত। সরকারি ট্রাস্টের নিরাপদ স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধু দক্ষ কারিগর তোয়াব খানের অধীনে কাজ করার লোভেই দৈনিক বাংলা ছেড়ে আমার মতো আরও অনেকেই জনকণ্ঠে যোগ দিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে আমরা জনকণ্ঠে আসার আগেই তোয়াব খানের কারিশমা জানতাম। ষাটের দশকে তিনি ছিলেন দৈনিক সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান এ যোগ দিয়েছিলেন। বার্তা সম্পাদক হিসেবে বাংলাদেশে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ফিচার পরিকল্পনায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ছিলেন তিনি। ১৯৭১-এ দৈনিক বাংলার বার্তা সম্পাদক সাহসী সাংবাদিক তোয়াব খান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে তাঁর কথিকাগুলো আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
যুদ্ধ শেষে ফিরে আসার পর দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদে নিয়োগ দেন। ১৯৭৩ সালে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহতের ঘটনার জেরে দেনিক বাংলার একটি টেলিগ্রাম প্রকাশের কারণে চাকরি হারান তোয়াব খান এবং কবি হাসান হাফিজুর রহমান। প্রেস সচিব করে কয়েক মাসের মধ্যেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি হাসান হাফিজুর রহমানকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশ দূতাবাসে এবং তোয়াব খানকে তার প্রেস সচিব পদে নিয়োগ দিয়ে আরও কাছে টেনে নেন।
আপাদমস্তক পেশাদার সাংবাদিক তোয়াব খান কোনোরকম দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কখনও কাজ করেননি।
প্রচারবিমুখ তোয়াব খান অর্থবিত্তের প্রতি নির্বিকার থাকার কারণেই সাংবাদিকতার শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্ব পালন এবং তিনজন সরকারপ্রধানের প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেও কোনোরকম কালিমা তার নামের আগে লাগতে দেননি।
সর্বশেষ হাজার ৯৯০ এর ডিসেম্বরে এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাকে প্রেস সচিবের দায়িত্ব দেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে তোয়াব খানের অবস্থা ত্রিশঙ্কু হয়ে পড়ে। এমন অবস্থা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও।তাকে প্রেস উইঙে নেয়নি জিয়ার সরকার। তথ্য মন্ত্রণালয় ফিরে যান তিনি,কাজ করেন তথ্য অধিদপ্তর এ।
দীর্ঘ১৯ বছর পরে যখন ১৯৯১ সালে তিনি আবার দৈনিক বাংলার সম্পাদক হলেন, তখন তাঁর ডিমোশন দেখে অনুরাগীরা বিষণ্ন বোধ করেছিলেন। সরকার যে বিএনপির, কী করে তাকে বহন করে! সচিব পদমর্যাদার একজন সিনিয়র সাংবাদিককে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ১৯ বছর আগের পদ ফিরিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।
তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবির পাশে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ছবি এবং নিউজ প্রথম পাতায় ছাপানোর ধকল এতটাই ছিল যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আপন চাচাতো ভাই দৈনিক বাংলার তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক ফওজুল করিমও (তারা ভাই) বোঝাতে পারেননি সরকারকে–এতে যেপত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা এবং মানও বাড়ে। মাত্র এক বছরের মধ্যে মৃতপ্রায় দৈনিক বাংলাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন তোয়াব খান। ফিচার পাতাগুলোকে এমন নতুন আঙ্গিকে আবার সাজালেন। শনৈ শনৈ সার্কুলেশন বাড়তে লাগলো। তাঁর তত্ত্বাবধানেই আমার দায়িত্বের ক্ষেত্র বদল হলো। আবারও সাহিত্যে ও ফিচার বিভাগে কাজ করার সুযোগ পাই আমি।
কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারলেন না তোয়াব খান। একদিন অকস্মাৎ তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এলো তার চাকরি অবসানের। বিনা বাক্য ব্যয়ে তিনি চলে গেলেন নিঃশব্দে। সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নির্বাহী সম্পাদক ফওজুল করিম তারা ভাইও সেদিনই তাঁর পিছু পিছু অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন, আর ফিরলেন না।
কিছুদিন পর দৈনিক বাংলায় ঢুকে চিফ সাব এডিটর খালেক দার কাছ থেকেই জানলাম তোয়াবভাই আমাকে ফোনে খোঁজ করেছেন। ফোন করার পর তোয়াবভাই বললেন একটা নতুন কাগজের যোগ দিয়েছি। যদি কাজ করতে চাও আসতে পারো।
পত্রিকার নাম কী, তাও জানতে চাইনি। জানতাম তোয়াব ভাই যা করবেন অসাধারণ কিছু হবে। দৈনিক বাংলায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।আগেই পদত্যাগ করেছি বলে তিনি আমাকে বকেছিলেন এবং প্রথম সাক্ষাতেই বললেন সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করবে, সহকারী সম্পাদক, সাহিত্যের পাতাও দেখে দেবে। সেই থেকে টানা ১৫ বছর একসঙ্গে তাঁর স্নেহের ছায়াতল থেকে দেখেছি কী অসাধারণ তার সম্পাদনার দক্ষতা, কি নিখুঁত দূরদর্শী পরিকল্পনা!কী বিস্তৃত তার পড়াশোনার পরিধি! বিস্মিত হয়েছি । ইংরেজি যেন তাঁর মাতৃভাষা, এত অনর্গল আর সুইফট রিডারও তার মত কাউকে আর দেখিনি। বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, বাংলা সাহিত্য, সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর উত্থান-পতন সবকিছু ছিল তাঁর নখদর্পণে! সাহিত্য জানেন বাংলার অনেক অধ্যাপকের চেয়েও বেশি। ফলে তিনি যে সম্পাদকীয় গাইডলাইন দিতেন, ব্রিফিং দিতেন, ফিচারের কোন পাতা কীভাবে আমরা সাজাবো, কার্যের ধারণা দিতেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। দৈনিক জনকণ্ঠের এটুজেড দেখে দিতে এক হাতে তিনিই।
নাসির আহমেদ, সাবেক, পরিচালক – (বার্তা), বাংলাদেশ টেলিভিশন