বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের আজ ৮ম মৃতু্যবার্ষিকী। ২০১২ সালের এইদিনে (১৯ জুলাই) তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মৃতু্যবরণ করেন। তার আগে দীর্ঘদিন মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই লেখক।
হুমায়ূন আহমেদ যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। দুই শতাধিক বই লেখার পাশাপাশি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তার মতো জীবনঘনিষ্ঠ গল্প আর কেউ বলতে পারেনি। বিশেষ করে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো এখনো প্রাণবন্ত। টিভি নাটকের বাকের ভাই, উপন্যাসের হিমু, রূপা কিংবা মিসির আলী চরিত্রগুলো এখনো সমসাময়িক। এসব চরিত্রের আবেদন বাংলা সাহিত্য কিংবা বাঙালি চিন্তা-চেতনার সঙ্গে আষ্টেপিষ্ঠে লেপ্টে আছে। জীবদ্দশাতেই তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। বাংলাদেশে তার মতো জনপ্রিয় লেখক কমই এসেছেন।
‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাস দিয়ে বাংলা সাহিত্যে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো আগমন ঘটে তার। এর মধ্য দিয়েই মধ্যবিত্ত ঘরে তিনি লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান। ধীরে ধীরে তার সাহিত্যের রসদ পৌঁছতে শুরু করে গোবেচারা বেকার যুবক-যুবতী থেকে ধনীর দুলালী পর্যন্ত। বিশেষ করে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসটি তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গেছে। হুমায়ূনের উপন্যাস মানেই বইয়ের দোকানে পাঠকের লাইন, বই মেলায় উপচেপড়া ভিড়। আর হিমু-মিছির আলী সিরিজ নিয়ে হট্টগোল কম হয়নি। ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কবি’, ‘বাদশা নামদার’ ইত্যাদি কত কত উপন্যাস, যা পাঠকদের মনকে ছুঁয়ে গেছে। কম সাধেই কি তাকে গল্পের জাদুকর ডাকা হয়! টেলিভিশনে মানুষকে নাটকমুখি করার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের তুলনা তিনি নিজেই। একইভাবে দেশি লেখকের বইয়ের পাঠক সৃষ্টিতেও বিশাল অবদান রয়েছে তার। তার লেখা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের জন্য রাজপথে মিছিলও হয়েছে। এক সময়ে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন। সেখানেও সফলতা আসে। প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে জয় করে নেন সিনেমাপ্রেমীদের মন। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমাটিও এ দেশের সফল সিনেমার একটি। সবশেষ পরিচালনা করেন ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। দীর্ঘ আট বছর ধরে হুমায়ূন আহমেদ স্ব-শরীরে নেই তার ভক্তদের কাছে। কিন্তু, রয়ে গেছে তার হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই- আরও কত সৃষ্টি! জোছনার প্রতি ছিল হুমায়ূন আহমেদের অসম্ভব রকমের ভালোবাসা। শহরের মানুষকে তিনি জোছনার প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন নাটক ও উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। ‘জোছনা বিলাস’ নামে রয়েছে তার উপন্যাস। জোছনা ও বৃষ্টির প্রতি ছিল তার টান। ‘বৃষ্টি বিলাস’ নামেও তার উপন্যাস রয়েছে। নুহাশপলস্নীতে একটি ঘরের নাম তিনি রেখেছিলেন বৃষ্টি বিলাস।
নন্দিত এই লেখকের ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্রের নাম বাকের ভাই। পরে এই উপন্যাসটি অবলম্বনে ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়। বিটিভিতে প্রচারিত হয় নাটকটি। বিটিভির ইতিহাসতো বটেই নাটকের চরিত্রকে কেন্দ্র করে এত সাড়া কখনো এই দেশে পড়েনি। নাটকে বাকের ভাইকে যখন ফাঁসি দেওয়া হবে, সে সময়ে ঢাকাসহ দেশে বেশ কয়েকটি স্থানে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে তারকাখ্যাতি পান আসাদুজ্জামান নূর। আজও এদেশের নাটকপ্রেমীরা মনে রেখেছেন বাকের ভাই চরিত্রটিকে। তাছাড়া তার ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ যৌক্তিক হাস্যরসের চমৎকার উদাহরণ তৈরি করেছে। নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা সাহিত্যে দীর্ঘ আট বছর এই জাদুকরের ছোঁয়া লাগেনি। এখনো বইয়ের দোকানে কিংবা বই মেলায় পাঠকরা উঁকি মারে হুমায়ুনের বইয়ে। একটু স্পর্শ করে দেখতে চায় প্রিয় লেখকের প্রিয় চরিত্রগুলো। কিংবদন্তিতুল্য এই সাহিত্যিকের ৮ম মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে আজ রাত ৯টায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে ম্যাড থেটারের ‘ভালোবাসি হুমায়ূন’ শীর্ষক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান। এই স্মরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন নাট্যদল বহুবচনের প্রধান তৌফিকুর রহমান, কবি সাখাওয়াৎ টিপু, নাট্যকার রুমা মোদক, বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, অন্যপ্রকাশের কর্ণধার ও লেখক মাজহারুল ইসলাম, বিশিষ্ট নাট্যকার মাসুম রেজা, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্রের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগম। অনুষ্ঠানে হুমায়ূন স্মরণে সংগীত পরিবেশন করবেন সুবচন নাট্য সংসদের সদস্য আমিরুল ইসলাম বাবুল।