স্মৃতি হয়ে গেলেন তিতাস উপজেলা প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধে , বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, কবি, কলামিস্ট, সমাজ সংস্কারক ও আলোকবর্তিকা বাহক আব্দুল মতিন মাস্টার। তিতাস উপজেলা প্রতিষ্ঠা এবং কলুষমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে আব্দুল মতিন মাস্টারের অবদান তিতাসবাসীর কখনো বিস্মৃত হবে না।
১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিতাস উপজেলার নিভৃত গ্রাম কানাইনগরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আব্দুল মতিন মাস্টারের জন্ম। তার বাবা মরহুম আব্দুল লতিফ মুন্সী একজন ধর্মভীরু এবং সামাজিক বুদ্ধিজীবী ছিলেন। জেল, জুলুম, হুলিয়া, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয় সংগ্রামী নেতা আব্দুল মতিন মাস্টারের শিক্ষা জীবন। তিনি ১৯৬১ সালে গৌরীপুর সুবল আফতাব উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি এবং ১৯৬৩ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে একই কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৮২ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন।
স্বাধীনচেতা এবং সামাজিক কল্যাণকামী ব্যক্তিত্ব আবদুল মতিন মাস্টার বরাবরই চাকরি বিমুখ ছিলেন। দেশ, জাতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির উন্নয়ন কল্পে কাজ করাই ছিল তার নেশা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এ সমাজ হিতৈষী তার প্রকৃত নেশাকে বাস্তবায়নের মানসে স্থায়ী কোনো পেশা গ্রহণ করেননি। তবে বিএ পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই তিনি তিতাস উপজেলার অনন্য বিদ্যাপীঠ গাজীপুর খান বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৫-১৯৬৯ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু দেশমাতৃকার টানে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে ব্রতী আব্দুল মতিন মাস্টার বেশিদিন শিক্ষকতা পেশায় থাকতে পারেননি। অবশ্য কিছুদিন তিনি গাজীপুর আজিজিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায়ও সহকারী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন।
সারাজীবন বিরোধী শিবিরের আপোষহীন ও বলিষ্ঠ রাজনীতিক, অন্যতম সংগঠক, নিরলস ও নিবেদিতপ্রাণ সংগ্রামী নেতা আব্দুল মতিন মাস্টার রাজনীতির সুফল ভোগ করতে না পারলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে একজন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যয়ন কালেই আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন এবং ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে কুমিল্লা জেলার অন্যতম ছাত্রনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সমাজকল্যাণ সম্পাদক ও কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৪ সালের ২১ নভেম্বর তিতাস উপজেলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ঐদিন স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের আয়োজিত আমিরাবাদ খেলার মাঠের জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন, তৎকালীন প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী মফিজউদ্দিন আহামদ। ভিক্টোরিয়া কলেজের তুখোড় ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন মাস্টারের নেতৃত্বে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও মৌলিক গণতন্ত্রকে রহিত করার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়। স্বৈরাচারী পাকিস্তানী সরকারের পেটুয়া পুলিশবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালালে সাগরফেনা গ্রামের কানুর মা এবং গাজীপুরের শাহআলম নিহত হন। এছাড়া আরও ৮/১০ জন গুলিবিদ্ধ হন। বিক্ষুব্ধ জনতা মন্ত্রীর লঞ্চটি টেনে ডাঙায় নিয়ে আসেন এবং মন্ত্রীকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। খবর পেয়ে কুমিল্লা থেকে শত শত রিজার্ভ পুলিশ এসে মন্ত্রীকে উদ্ধার করে নিয়ে যান৷ এ ঘটনায় তার নেতৃত্ব বিকাশের পথ সুগম হয়।
আব্দুল মতিন মাস্টার ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের সশস্ত্র
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন৷ তিনি ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-১ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। তিনি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ভাসানী ন্যাপের কুমিল্লা জেলা কমিটির সহসভাপতি, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় আব্দুল মতিন মাস্টার এলাকার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রভূত উন্নয়নকল্পে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সংঘ (আসকু) গঠন করে এ অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। আশির দশক থেকেই তিনি দাউদকান্দি উত্তরাঞ্চলের ৯টি ইউনিয়নকে নিয়ে পীর শাহবাজনগর থানা প্রতিষ্ঠা আন্দোলন শুরু করেন যার ফসল আজকের তিতাস উপজেলা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার এ সংগ্রামী রাজনৈতিক এবং সমাজ সংস্কারমূলক কার্যক্রম নতুন প্রজন্মের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।