বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য নামে পরিচিত। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্য বাংলা ভাষায় রচনার সূত্রপাত হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোহা-সংকলন চর্যাপদ বাংলা-সাহিত্যের প্রচীনতম নিদর্শন। আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-আরও তিনটি গ্রন্থের সাথে চর্যাপদগুলো নিয়ে সম্পাদিত গ্রন্থের নাম দেন ‘হাজার বছরের পুরনো বাঙলা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোহা’ ।
মধ্যযুগীয় বাংলাসাহিত্য ছিল কাব্য প্রধান। ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্ম বিশ্বাসগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। ইসলামী ধর্মসাহিত্য,পীর সাহিত্য, বাউল পদাবলী, পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ, মঙ্গলকাব্য, বৈঞ্চব পদাবলী, বৈঞ্চব সন্তজীবনী, রামায়ন, মহাভারত ও ভগবতের বঙ্গানুবাদ, নামসাহিত্য ইত্যাদি ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত খ্রিষ্টীয়-অষ্টাদশ শতাব্দিতে। উনবিংশ শতাব্দিতে বাংলার নবজাগরনের যুগে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই সময় থেকে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বদলে মানুষ, মানবতাবাদ ও মানব মনস্তত্ব বাংলা সাহিত্যের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাংলা সাহিত্য দুটি ধারায় বিভক্ত হয়। ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাহিত্য ও কলকাতা কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য। বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বিশ্বের একটি অন্যতম, সমৃদ্ধ সাহিত্যধারা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।
প্রাচীন বাংলাসাহিত্যে প্রতিফলিত সমাজ জীবন, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ-জীবন, আধুনিক যুগের সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতা, গীতিকবিতায় বিধৃত সমাজ, কথাসাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতা, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজ, পূর্ববাংলার সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতার চিত্র, আধুনিক সমাজ ও সাহিত্য, সাহিত্যে সমাজ-চেতনার স্বরূপ সংস্কৃতিতে চিত্রায়ন হয়েছে।
সাহিত্য সমাজের দর্পন স্বরূপ । আর মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। তাই সাহিত্যের মধ্যে আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা পাওয়া-না পাওয়ার সুখ-দু:খ ভালোবাসা-ঘৃণা সাফল্য-ব্যর্থতা প্রভৃতি জীবনের যে প্রতিবিম্ব অঙ্কিত হয় তাই সমাজের বাস্তবতা ও প্রতিচ্ছবি। সুতরাং সাহিত্যের সঙ্গে জীবন তথা সমাজের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
তাই একথা বলতেই হয়, যেকোনো সাহিত্যের সূচনা পর্বে সমাজের চিত্র অনুপস্থিত ছিল। কেননা সেখানে ছিল তখন মানুষের থেকে দেব-দেবী, পৌরানিক কাহিনী, ধর্ম-চেতনার বিষয়াদি। কিন্তু সাহিত্য যখন আরো সমৃদ্ধ হয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা বা সমাজের প্রেক্ষাপটে উঠে আসলো তখন সাহিত্যে তার বাস্তবতা বিধৃত হলো ও সাহিত্য হয়ে উঠলো সংস্কৃতি সমৃদ্ধ।
পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলাসাহিত্যের প্রচীন নিদর্শন চর্যাপদ ও ধর্মীয় চেতনা-সমৃদ্ধ ছিল। তবে চর্যাপদে ধর্মীয় চেতনার গভীরে ছিল মানুষের জীবনবোধ। এ সব চিত্র মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বৌদ্ধ-সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধনসংগীত, যা ছিল সাংকেতিক ভাষায় রচিত। এই সঙ্গীতে ধর্মকে অতিক্রম করে মানুষের প্রসঙ্গ এসেছে এবং সমাজবাস্তবতার ছবিও প্রতিফলিত। তাই আবহমান বাংলার দারিদ্রপীড়িত সমাজ জীবনের পরিচয় ও চর্যাপদে রয়েছে। সাধন-সঙ্গীতের অন্তরালে বাঙালীর একান্ত আটপৌঢ়ে দু:খ-দৈন্যের কথা এভাবে বলা হয়েছে।
টালত মোর ঘর নাহি পড় বেশী
হাড়িতে ভাত নাহি নিতি আবেসী ॥
এ কথার অর্থ হলো-প্রতিবেশীহীন এক টিলার ওপর ঘর, হাঁড়িতে ভাত নাই অথচ, প্রতিদিন প্রতিবেশির আগমন ঘটেই। এই ব্যাখ্যায় পদটির যে-তাৎপর্যই থাকুক না কেন, এখানে জীবনের কথাও সমান বাস্তবতার কথা নিখুতভাবে পাওয়া যায়। এ-ছাড়াও শ্রেণী বৈষম্য-ও বর্ন বৈষম্যের দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়।
নগর বাহিরে রে ডোম্বি-তোহারি ॥
ছোট ছোই কুড়িয়া জাসি সো বাহন নাড়িআ ॥
এখানে ডোম্বি শ্রেনী-ও ব্রাক্ষণ-শ্রেণীর কথা বলা হয়েছে। কাহ্নপার এ পদ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, সে সমাজেও উচুঁ-নীচুঁ ভেদাভেদ বিদ্যমান ছিল। এভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করলে চর্যাপদগুলেতে সমাজ-জীবনের বাস্তবচিত্র যথেষ্ঠ আছে।
বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ অনুযায়ী ১২০০-১৩৫০ পযর্ন্ত সময়কে মধ্যযুগ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সময়কালে মুসলিম শাসন ছিল। মুসলিম শাসন আমলের কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। গবেষকদের অনুমান নানা বিশৃঙ্খলার যুদ্ধবিগ্নহের কারণে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় নাই। বেশীরভাগ শিল্প-সাহিত্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অমর রচনা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এ ছাড়াও চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এ যুগের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। ১৪৮৬-১৫৫০ আমরা মনোযোগ দিলে দেখতে পাই যে, দেবতা কৃষ্ণ ও রাধার হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটি ধর্মের আবরণে যাই থাকুক না কেন, মানব সমাজে এটির রূপায়ন সমাজের আর দশটি ঘটনার মতোই প্রবাহিত। দেব-দেবীর স্থলে গ্রামীন সাধারণ নর-নারীর এক গভীর প্রেমের চিত্রই এখানে মূখ্য। আবার চৈতন্য-দেবের আবির্ভাবের ফলে রাধা-কৃষ্ণের এরূপ প্রেমলীলাও সমাজের অমর প্রেমের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়েছে। তাই এর সহজ উচ্চারণ-
শত কোটি গোপীর সঙ্গে কৃষ্ণ-প্রেম রসঙ্গে ॥
এ ছাড়াও মধ্যযুগে আরো কিছু সাহিত্য-শিল্পের বিকাশ ঘটে, ধর্মপ্রধান এ সাহিত্যে। কিন্তু মানব-জীবন ও সমাজের দৃষ্টান্ত বিরল-নয়। বিরল রচনা-মঙ্গলকাব্য। যেখানে সাধারণ মানুষের আকুতি বিশেষ করে দেবীর কাছে ঈশ্বর পাটনির প্রার্থনা।
‘‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’’ ॥
সত্যি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে পাটনির এই সহজ-সরল চাওয়া শাশ্বত বাঙালি সমাজের মৌল আকাঙ্খাকে উপস্থাপিত করেছে। এ ছাড়াও চন্ডীদাসের সেই সুপরিচিত উদ্ধৃতি ‘‘সবার উপরে মানুষ সত্য’’ অর্থাৎ মধ্যযুগের সাহিত্যের মধ্যে দেব-দেবীর কথা থাকলেও এর অন্তরালে মানুষের কথা, সমাজের কথাও সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত। তাই আজ যে আধুনিক সাহিত্যের উৎকর্ষের দাবি করা হয় তার ভিত্তি-ভূমিও হতে পারে মধ্যযুগের সাহিত্য।
বিশ্বায়নের প্রভাবে পৃথিবীব্যাপী সমাজ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। পুঁজিবাদের উলঙ্গ বিকাশে মানুষ ক্রমাগত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। পুঁজিপতি আরো ধ্বনি হচ্ছে, ফলে সমাজে সর্বহারা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। সমাজে জন্ম নিচ্ছে নানা ধরনের অসংগতি, ক্ষোভ আর হতাশা। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বসাহিত্যে প্রকাশবাদী, প্রতীকবাদী এবং অতি বাস্তবতাবাদী কিংবা শূন্যতাবাদী আন্দোলন, ও স্থান করে নেয়। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে এ আন্দোলন স্থান করে নিয়েছে।
আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের বহু কবিতায় পরাবাস্তবতার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও উত্তর আধুনিকতা বাদে সমাজের অন্তর্নিহিত পরিবর্তনও সাহিত্যে ধরা পড়ছে। তাই যান্ত্রিক সভ্যতায় পরাস্ত মানবতার হাহাকার এবং ব্যক্তি নিঃসঙ্গতা অন্যান্য সাহিত্যে ও সমাজেও বিদ্যমান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সাহিত্যে প্রতীয়মান। সমাজে অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অশ্বস্তি প্রকটভাবে দেখা দেয়। মানুষের সুখ-দুঃখ, পাপ-পূন্য সংশয় আর টানাপোড়েনের চিত্র নিয়ে রচিত হয় অসংখ্য সাহিত্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আবার নতুন সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়। এ ধারাবাহিকতায় দেশ বিভাগ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত-সমাজ জীবনের চিত্র বিস্তৃতভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। সুতরাং সাহিত্য প্রকারান্তরে মানব সমাজের এক জীবন্ত দলিলে পরিণত হয়।
সমাজ-জীবন থেকেই সাহিত্য রসদ সংগ্রহ করে। তাই সমাজ-বাস্তবতাই সাহিত্যের উৎকর্ষ কিংবা অপকর্ষ নির্ণয়ের মাপকাঠি। তাই বলা যায় সাহিত্য সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি।
লেখক : সমন্বয়কারী, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি