বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। অন্য শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গুনগত বিস্তর পাথক্য রয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবগুলো আমরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যক্ষ করেছি। শিল্পবিপ্লবের সময়ে সৃষ্ট বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ও খাপ খাইয়ে নিতে মানুষ যথেষ্ট সময় পেয়েছে। পরিবর্তনের ধরনগুলো বুঝতে পেরেছে এবং গতি-প্রকৃতি সর্ম্পকে সম্মুখ ধারণা নিতে পেরেছে। অন্যদিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের উৎকর্ষতা থেকে দ্রুততম সময়ে সৃষ্টি হয়েছে এবং অতি সহজে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সৌন্দর্য হলো, কল্পনার চেয়েও এর অনিশ্চয়তা এবং অসীম সম্ভাবনা। এ সময় মানুষ ধারণা করতে পারছে না, কত অল্প সময়ের মধ্যে তার চেনা পৃথিবী, সমাজ ও মানুষ পাল্টে যাচ্ছে। এ সময় সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানুষের মেধা,দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও নির্ভুলতা। একমাত্র শিক্ষাই পারে সময়োপযোগী জাতি ও জনসম্পদ তৈরি করতে। এ লক্ষ্য অর্জনে উচ্চশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এটাই স্বাভাবিক, তবে তা হতে হবে মানসম্মত, বাস্তবভিত্তিক ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী। এ ক্ষেত্রে কোন দেশ কতটা ধনী বা কতটা বড় সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, প্রয়োজন অনুযায়ী মেধা ও চর্চা দিয়ে দক্ষতা অর্জনই বড় কথা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অনিশ্চয়তা ভরা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য মানসম্মত উচ্চশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ একটি উদীয়মান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এই বিষয়টির দিকে নজর দেয়া অপরিহার্য, তা না হলে দ্রুত পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়বে।
আত্মমর্যাদাশীল আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার ক্ষেত্রে মান অর্জনের বিষয়ে কোনো প্রকার সমঝোতা করার সুযোগ নেই। শিক্ষাকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে যেন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। এর জন্য সীমিত সম্পদের মাঝেও সব উপকরণের আয়োজন করতে হবে। কারণ শিক্ষায় অর্জন শুধু সংখ্যার উপর নির্ভর করে নির্ণয় করার সুযোগ নেই, একে নির্ণয় করতে হবে মানের উপর নির্ভর করে। তাই শিক্ষায় অর্জন তখনই কার্যকর হবে, যখন আমরা একটি মানসম্মত টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হব। বিষয়টি যখন আর্থসমাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হবে এবং জাতিগঠনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে, তখন যেকোনো প্রেক্ষাপটেই রিসোর্স কোনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না। যে দেশ মানসম্মত উচ্চশিক্ষায় পরিমাণগত ও গুণগতভাবে পিছিয়ে আছে, তাকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। যেন কোনো বিষয়েই সমঝোতা না করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় পরিমাণগত ও গুণগত বিকাশ একই সঙ্গে ঘটানো যায়।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্তরকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে- প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর, যা সাধারণত বারো বছর স্কুলিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবঙ উচ্চশিক্ষা স্তর, যা সাধারণত তের বছর স্কুলিং থেকে ষোল বছর এবং তার পরও আরো পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রথম স্তরটিতে পরিমাণগত বিকাশ প্রাধান্য পেয়ে থাকে, কারণ এই শিক্ষা কোনো জাতির সবার জন্য নিশ্চিত করার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে এবং তা নিশ্চিত করাটাই অপরিহার্য। উচ্চশিক্ষার স্তরটি সম্পূর্ণভাবে আলাদা প্রকৃতির, এতে গুণগত বিকাশটাই কাঙ্খিত এবং এর বাইরে যাবার কোনো সুযোগ নেই, যদি কখনো তা ঘটেও তাহলে সেটা কোনো জাতিকে সামনে এগিয়ে না নিয়ে একটি অপ্রত্যাশিত এবং অনিয়ন্ত্রিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যা কোনোভাবেই কোনো অগ্রসরমান দেশ বা জাতির জন্য কাম্য নয়।
শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত উন্নয়ন এবং পুরো শিক্ষাব্যস্থার ক্রমশ বিকাশ ঘটিয়ে একটি ধরাবাহিকতার স্থায়ীরূপ নিশ্চিত করার জন্য যে বিষয়গুলো সামনে চলে আসে তা হলো সবার জন্য উন্মুক্ত ও বৈষম্যহীন, সমন্বিত ও মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষক্রম ও কাঠামো। মেধাবী, আধুনিক ও উন্নত ধ্যান-ধারণায় গড়ে ওঠা এবং পেশার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ শিক্ষকসমাজের হাতে তুলে দিতে হবে এ দায়িত্ব। এছাড়া অংশীজনদের অংশগ্রহণ, আর্থিক ও প্রশাসনিক টেকসই ব্যবস্থাপনা সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের ধাপ অনুযায়ী চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে গড়ে তোলার জন্য নিশ্চিত করতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ। সামষ্টিকভাবে যে কোনো অর্জনের জন্যই প্রয়োজন যথাযথ বিষয়বস্তুর যোগান, যা শিক্ষার স্তর অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে, যেন সম্পদের সংকট বা সীমাবদ্ধতা কোনোভাবেই কাঙ্খিত ফল অর্জনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে না দাড়াঁয়। শিক্ষার প্রধান দুইটি স্তরের মধ্যে যেমন প্রয়োগিক ও অর্জনের বিষয়টির মাপকাঠির পার্থক্য রয়েছে, তেমনি একটি অন্যটির সফলতার উপর নির্ভরশীল। সঠিক এবং মানসম্মত প্রথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার সঠিক বিকাশ ছাড়া গুণগত উচ্চশিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়, তেমনি গুণগত উচ্চশিক্ষাই পারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সফলতা নিশ্চিত করার সবচেয়ে মূল্যবান উপকরণ উপযুক্ত শিক্ষক যোগান দিতে।
এটা অনস্বীকার্য যে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিরাজমান এবং ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তায় ভরা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য যে কোনো দেশ ও সমাজ উচ্চশিক্ষার প্রকৃতি ও মানের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। স্বাধীনতার এ দীর্ঘ অর্ধশতক অতিবাহিত হলেও আমরা এখনো শিক্ষার কোনো স্তরেই সঠিক মান নিশ্চিত করার বিষয়ে সফলতা অর্জন করতে পারিনি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চতর কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সুনিপুণ মেধা ও উচ্চতর জ্ঞানে সমৃদ্ধ উদ্ভাবনী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে। চলমান শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে এমন একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে যাদের মধ্যে থাকবে কর্মানুরাগ, চিন্তার স্বধীনতা, ন্যায়বোধ ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বিকশিত হবার অন্তর্নিহিত স্পৃহা। উচ্চশিক্ষায় গবেষণার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি এবং এ লক্ষ্যে বাস্তবায়নযোগ্য রোড ম্যাপও আমরা তৈরি করতে পারিনি। বিচ্ছিন্ন কিছু সফলতা আর উদ্যোগ এক্ষেত্রে এখনো কোনো টেকসই পদচিহ্ন রাখতে পারেনি। গবেষণার মাধ্যমেই যে কোনো বিষয়ে সব দিগন্তের উম্মোচন ঘটে, যার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলি বিশ্লেষণ করে সমাধানের সঠিক পথ এদেশের প্রেক্ষাপটেই উদ্ভাবিত হবে।
উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে কীভাবে একটি টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে নিজস্ব কিছু ভাবনা তুলে ধরাই এই লেখার প্রধানতম উদ্দেশ্য। উচ্চশিক্ষায় এসে মেধাবী তরুণরা যেন আস্থাহীনতার সংকটে না ভোগে এবং তারা নিজের, পরিবারের ও জাতির জন্য সীমাহীন উদ্বেগের কারণ হয়ে না দাড়ায় এটা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় গ্রহণের আসন রয়েছে প্রায় ১৩ লক্ষ। গাণিতিক হিসাবে যা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যার চেয়েও বেশি। প্রতি বছর বেশ কিছু আসন শূন্যও রয়ে যায়। সঠিক ডাটা বা তথ্যের অভাবে, আমরা উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন বিষয়বস্তুর আসনসংখ্যা নির্ধারণ করতে পারিনি। শিক্ষার্থীরা কোন বিষয়টিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলে তা দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপযোগী, এটা নির্ধারণ করে আসন বিন্যাস করার কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করা এখনো সম্ভব হয়নি। এই বিষয়ে কোনা সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেবার আইনগত বা প্রথাগত সুযোগ কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। এমনকি শিক্ষার্থীরা কোন বিষয়ে গবেষণা বা পড়তে আগ্রহী তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। গবেষণার সঠিক ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে ’ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল’ গঠন করার উদ্যোগটি বিভিন্ন জটিলতায় আটকে আছে, যা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন উদ্যোগ নেবার পরও আমরা ব্যর্থ হয়েছি একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বা যাচাই-বাছাই পদ্ধতি অনুসরণ করে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার স্তরে ভর্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে। সমন্বয়হীন বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণের কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর শেষ করে উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রবেশ করতে দীর্ঘ সময় চলে যায়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তা ১২ মাসও হয়ে যায়। শিক্ষাজীবন নষ্ট হওয়াসহ শিক্ষার্থীরা সীমাহীন আর্থিক ও অন্যান্য দুর্ভোগে পড়ে। উপরন্তু আমরা ব্যর্থ হয়েছি একটি সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে, যাতে বিষয়বস্তু ও প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে সব শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয়টি সমভাবে গুরুত্ব পাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিজের পছন্দের বা ইচ্ছার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন বিষয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। একজন শিক্ষার্থী ১২ বছর স্কুলিং শেষ করার পর, উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে বা তার কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠান বা বিষয়বস্তুতে ভর্তি হতে কতবার এই ভর্তি পরীক্ষা বা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে এখনো তা সমন্বিতভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। এছাড়া একজন শিক্ষার্থী একটি নির্দিষ্ট বিষয়স্তু নিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করার পর শিক্ষাজীবন বা সময় নষ্ট না করে বিষয়বস্তু পরিবর্তন করারও সুযোগ নেই। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমরা এখনো কোনো গ্রহণযোগ্য ও টেকসই ব্যবস্থা নির্ধারণ করতে পারিনি। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী প্রবেশের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিটি আমরা এখনো ত্রুটিমুক্ত করতে পারিনি। বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা জাতির উপর চাপিয়ে দিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই আয়োজন সম্পন্ন করছে। এমনকি দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধ এই বিষয়ে এখনো সংশ্লিষ্টদের নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারেনি। উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের এই অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সমাধানে অবশ্যই একটি গ্রহণযোগ্য ও ত্রুটিমুক্ত পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। এজন্য নিজস্ব ধ্যান-ধারনার ঊর্ধ্বে উঠে বিষয়টি নিয়ে খোলামনে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য টেকসই সমাধান বের করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে, কারণ তারাই এক্ষেত্রে প্রধান স্টেকহোল্ডার। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে এটিও একটি অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য আসন কোনো সংকট নয়। তবে তীব্র সংকট রয়েছে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ভর্তি হতে ইচ্ছুক বিষয়ে আসনসংখ্যা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সক্ষমতার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৫২ তে, অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮টি। ১৯৯২ তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় একটি যুগান্তকারী ঘটনা, যা সৃষ্টি হয় উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরও দেশের মধ্যে ধরে রাখার জন্য এবং দেশেই উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার লক্ষ্য নিয়ে। বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তার প্রায় চার গুণ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজধানী ও বড় বড় শহর কেন্দ্রিক, এতে রয়েছে আকর্ষণীয় বিষয়স্তুতে পড়ার সুযোগ। তবে হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যায় ছাড়া অন্যগুলো মান অর্জন করতে সক্ষম হয়নি এবং শিক্ষা/গবেষণা করার পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে, এরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প হিসেবে নিজেদের দাঁড় করাতে পারেনি। এছাড়া রয়েছে সরকারি/বেসরকারি কলেজগুলোতে বিশালসংখ্যক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আসন। সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় ৩ হাজার কলেজে উচ্চশিক্ষায় রয়েছে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হবার সুযোগ। এর বাইরে রয়েছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মেডিক্যাল কলেজ ও অন্যান্য বিশেষায়িত কলেজ/ইনস্টিটিউশনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এক্ষেত্রে প্রায় ১২ শতাংশ। একেবারে উদারভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, বর্তমান অবস্থায় আমরা মাত্র উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিতে সক্ষম হয়েছি, যারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো জ্ঞান, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী মননশীলতা নিয়ে নিজেদের তৈরি করতে সক্ষম হবে। মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের সংখ্যার বিচারে বিষয়টি খুবই হতাশার এবং উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এটাই হচ্ছে বাস্তব চিত্র, যা আমাদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সক্ষমতাকে একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
উদীয়মান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক প্রতীক্ষার পর আমরা ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি পেয়েছি, ২০০৬-২০২৬ সালব্যপী স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন তৈরি করে দিলাম, যার অর্জনসমূহ বিশ্লেষণ না করেই আবার আমরা নতুন একটি তৈরি করলাম ২০১৮-২০৩০ পর্যন্ত, দীর্ঘদিনের অবহেলার স্বীকার কলেজ এডুকেশনের উচ্চশিক্ষা উন্নয়নের জন্য একটি স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান তৈরি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউশনাল কোয়লিটি অ্যাসুরেন্স সেল তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আউটকাম বেসড এডুকেশন কারিকুলাম চালু হয়েছে, ব্লেন্ডেড লারনিং এডুকেশন পলিসির প্রস্তুতি চলছে, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এডুকেশন ও রিসার্চ নেটওয়ার্কের আওতায় আনার জন্য বিডিরেন (বাংলাদেশ এডুকেশন ও রিসার্চ নেটওয়ার্ক)-এর সক্ষমতা ও বিস্তৃতি বাড়ানো হচ্ছে, এছাড়া সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করার প্রায় সব আয়োজন সম্পন্ন করে নিয়ে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একসঙ্গে কাজ করার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়বস্তুর ওপর কনফারেন্স আয়োজন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হবার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এরপরও কি আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি যে, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আমাদের মান উন্নয়নের বিষয়টি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হবো? বিগত বছরগুলোর অর্জন দেখলে আস্থা রাখার দৃঢ় কোনো ভিত্তি দেখছি না। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় মান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে পরিমাণগত নয়, গুণগত অর্জনই মুখ্য। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে-এ অর্জন কীভাবে সম্ভব। আমরা কীভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে এ লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাব।
বিশ্ব র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থেকে উপলদ্ধি হয়েছে যে, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় মান উন্নয়নে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যায়, যা ইউজিসির মাধ্যমে সরাসরি সরকারপ্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে কাজ করবে। উচ্চশিক্ষার বিষয়বস্তু, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও গবেষণার ধরন নির্ধারিত হবে দেশীয় প্রয়োজন ও সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও গবেষণাগারের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষকদের যোগান নিশ্চিত করা। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানসম্মত শিক্ষক ও গবেষকদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখা। বর্তমানে যে সব প্রতিষ্ঠান ও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা প্রদানের প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ নিশ্চিত করা যায়নি, তা অর্জন করা সম্ভব না হলে ঐ সব প্রতিষ্ঠান ও বিষয়বস্তু অবশ্যই বন্ধ করে দেয়ার মতো শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। পুরো বিষয়টি নিয়ে গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে কাজ করতে হবে। তা না হলে, সময় যাবে কিন্তু প্রাপ্তির উৎকন্ঠা বাড়বে। বর্তমান ধারায় চলতে থাকলে আমরা কোনোভাবেই গুণমান নিশ্চিত করতে পারব না। অন্যরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাবে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অন্যদের তুলনায় আরো পিছিয়ে পড়বে।
বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে স্বকীয়তা নিয়ে কাজ করার এবং কাঙ্খিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার আর্থিক, একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বাইরের সব ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। তাবে অবশ্যই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোর মধ্যে থাকতে হবে। তাই উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সব আয়োজন বা উপকরণ অর্থাৎ শিক্ষার্থী, শিক্ষক/গবেষক, অবকাঠামো, গবেষণাগার, সহযোগী স্টাফ, পরিচালনা পর্ষদ, সবকিছুই হবে শুধুমাত্র এবং একমাত্র মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে যিনি বা যারা নেতৃত্ব দেবেন, তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, যোগ্যতা এবং নিয়োগপদ্ধতি থাকবে প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। যার হাতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের নেতৃত্ব, তার নিয়োগ প্রক্রিয়াটি হবে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের। নিশ্চিত করতে হবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং সঙ্গে সঙ্গে সর্বোচ্চ জবাবদিহিতার বিষয়টি। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে বিশেষ মর্যাদার স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকি করার জন্য একটি স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করা। দীর্ঘ ৫০ বছরের অগ্রগতি, কর্মপদ্ধতি ও অর্জন বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান যে, দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে সৃষ্ট স্বাধীন দেশের প্রেক্ষাপটে এবং বঙ্গবন্ধু যে চিন্তাভাবনা নিয়ে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন, আমরা সেটা লালন করতে পারিনি বলেই কাঙ্খিত স্থানে পৌঁছাতে পারিনি। এখন সময় এসেছে আত্মোপলদ্ধি ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছার।
লেখক : অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। কৃতজ্ঞতা : ইরাব।