পদ্মাসেতু হওয়ার পর যশোর বিভিন্ন দিক থেকে দেশের অন্যতম বিজনেস হাব হতে যাচ্ছে। ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আয়োজিত এনবিএফআই মেলা-২০২২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন। বণিক বার্তার আয়োজনে ৩০ নভেম্বর যশোরের ওরিয়ন ইনটারন্যাশনাল হোটেলে দিনব্যাপী এ মেলার উদ্বোধন করেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। ঢাকার বাইরে প্রথমবারের মতো দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, যশোর দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এলাকা। এ জেলার শাক-সবজি, বিভিন্ন ধরনের ফল, ফুল, মিষ্টি, খেজুরের রস বিখ্যাত। পদ্মাসেতু হওয়ায় অর্থনৈতিক সুযোগ আরও বেড়েছে। অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বণিক বার্তার এ আয়োজন মূলত সামাজিক দায়বদ্ধতারই বহিঃপ্রকাশ। ব্যাবসা মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক হয়ে আছে। এতে বৈচিত্র আনা দরকার। আর্থিক খাত হলো আমাদের শিরা-উপশিরা। আর এই আর্থিক খাতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো অব্যাংকিং আর্থিক খাত। জামানতের বাইরে ব্যাবসার সম্ভাবতা ও ঐতিহ্য চিন্তা করে অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লোন দিয়ে থাকে। ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা ঋণখেলাপি। বড় বড় কোম্পানীগুলো ঋণখেলাপি করে। কিন্তু অব্যংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ ঝুঁকি কম। এখানে কম সুদে লোন দেয়া হয়। যশোরে বিনিয়োগে অনেক সুযোগ রয়েছে। কৃষি খাতে বিনিয়োগের অপার সুযোগ রয়েছে। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশের ৬০ ভাগ শাক-সবজির যোগান দেয়। এসব কারণে সব ব্যাংকের শাখা এই জেলায় আছে। এসএমই খাতে সবচেয়ে বেশি সেবা দেয় অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আশা করবো এ জেলায় ব্যাবসায়ীরা বিনিয়োগ বাড়াবে। বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দেশ। ভারতের চেয়ে মাথাপিছু আয় ও শিক্ষার হার আমাদের বেশি। শিশুমৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বনিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশের ব্যাবসা বাণিজ্য মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক। পদ্মা সেতু হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাবসা বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ার যে আবেদন সেটাকে লক্ষ করে আজকের আয়োজন। অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। আজকের এ অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্দ্যেশ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যশোরে নিয়ে আসা।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, যশোর ব্রিটিশ বাংলার প্রথম স্বাধীন জেলা। কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী যশোরকে টার্গেট করেছেন অর্থনৈতিক বিস্তৃতির ক্ষেত্রে। যশোরকে আমরা আগামীর বিজনেস হাব হিসেবে ধরে রেখেছি। যারা বিনিয়োগ করবেন যশোরকে মাথায় রাখবেন। খুলনা বিভাগের অর্থনীতি যশোরকে ঘিরেই। যশোরের সবজি ও ফল ঢাকার ৭০ ভাগ কাভার করে। ফুলের রাজধানী যশোরে। যশোরে বৈশাখ মাসে ৬-৮ কোটি টাকার ফুলের বিজনেস হয়৷ ব্যাংকের যে সমস্যা আছে নন ব্যাংকিং এ আসলে সেগুলো অনেকটা কমে যায়। জনগণের জন্য সুদহার আরও কমিয়ে আনার আহবান জানাচ্ছি। তাহলে দক্ষিণ-পশ্চিম আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। যশোর ছাড়াও অন্যান্য জেলাগুলোতে এ মেলার আয়োজন করলে পুরো দেশ এগিয়ে যাবে।
যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহিন চাকলাদার বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি পর্যায়ে লোন দিবে, কাদের দিবে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। যশোরের মানুষ খেলাপি করে না। যশোরের মানুষ ভালো। আতিথেয়তা ও কমিটমেন্ট পূরণে বদ্ধ পরিকর। ব্যাংকগুলোতে যখন লোন নিতে যাই তাহলে জামানত দিতে হয়। নতুবা লোন পাওয়া যায় না। লোনের বিষয়টা পরিষ্কার করলে আরও সুনিধা হবে। রাজধানীর পর যশোরে প্রায় সব ব্যাংকের শাখা আছে। এখানের সবজি সারা দেশে যায়। পদ্মা সেতু বা রেলই নয়, রুপসা সেতু, কালনা সেতু এসব যশোরের অহংকার। আমরা তিনঘন্টায় ঢাকা পৌছে যাচ্ছি ৷ আগে সবজি পৌছাতে অনেক খরচ হতো। এখন দ্রুত পৌছে যায়, কম খরচে। বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ ব্যাবস্থা উন্নত করতে চেয়েছেন। সেটা তার কন্যা পূরণ করছেন। আজ বাংলাদেশ উন্নত বাংলাদেশ। খুলনা বিভাগীয় শহর হলেও বিজনেসে লিড দিচ্ছে যশোর।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: রফিকুল হাসান বলেন, করোনার মাঝামাঝি সময়ে একজন নারী উদ্যোক্তা ফোন দিয়েছিলেন, তিনি ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারছে না। আইডিএলসি থেকে ৩ কিস্তিতে ৮৫ লাখ টাকা নিয়েছে। তার ব্যাবসা বড় হয়েছে। সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প এখন যশোর নির্ভর হচ্ছে। বসুন্ধরা গ্রুপ এখানে অনেক ভূমি কিনতে চেয়েছে। ইপিজেড হচ্ছে, ভূমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষ। এখানে মাছ, শাক-সবজি, আরএমজি, টেক্সটাইল সব খাতই সম্ভাবনার। বেনাপোল থেকে ভাংগা পর্যন্ত ৬ লেন সড়ক হবে। যশোর থেকে মংলা পর্যন্ত ৬ লেন হওয়ার কথা রয়েছে। রেললাইন সম্প্রসারণ হবে। পদ্মার রেল প্রজেক্ট চালু হলে সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে। দেশের সর্ববৃহৎ অটোমোবাইলস শিল্প যশোরে। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যশোরে আসার অনুরোধ জানাবো।
বিএলএফসিএ এর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, ঢাকার বাইরে প্রথম এনবিএফআই মেলা হতে যাচ্ছে সেখানে যশোরকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। এটা যশোর অর্জন করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসএমই খাতে অর্থায়ন ও প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে। যশোরে খেলাপি কম। ব্যাংকগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। অন্যদিকে অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়িতে গিয়ে দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়। ব্যাংকে গেল জামানত আছে কি না শুনতে হয়। অব্যাংক প্রতিষ্ঠানে বেশিরভাগ ঋণ দেয়া হয় জামানত ছাড়া। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। দক্ষিণাঞ্চলে জীবনমান উন্নয়নে এ মেলা ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক খুলনা অফিসের নির্বাহী পরিচালক এস. এম. হাসান রেজা বলেন, পদ্মাসেতু হওয়ার পর যশোর বিভিন্ন দিক থেকে বিজনেস হাব হতে যাচ্ছে। দেশের বড় স্থলবন্দর যশোরে। এয়ারপোর্ট আছে। যশোর অঞ্চলে ছয়টা এনবিএফআই এর কার্যক্রম চলছে। আরও কিছু আশাবাদ ব্যাক্ত করেছে। আমি দেশের ৩৩ অব্যংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সবাইকে যশোরে কার্যক্রম পরিচালনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। সহায়তা প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সকল সহায়তা দেয়া হবে।
লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও খাজা শাহরিয়ার বলেন, একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম। ব্যাংক ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। বহুকাল থেকে দক্ষিণাঞ্চল বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত। পদ্মাসেতুর পর সেটা আরও প্রকট হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে লংকাবাংলা ঋণ বিতরণ করে আসছে। দক্ষণাঞ্চলের পরিবহন, কৃষিপণ্য উৎপাদন ও গবাদিপশুর উন্নয়নে লংকাবাংলা সহায়তা করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. কায়সার হামিদ বলেন, যশোর বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন জেলা। কিন্তু অর্থনীতিতে নদীর কারণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এখন পদ্মাসেতুর কারণে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা বিডি ফাইন্যান্স নারীদের জন্য প্রথমবার ঋণ নেয়া এমন ৮০০ জনকে লোন দেয়া হয়েছে। প্রথম আমরাই নারীদের ৪% সুদে লোন দিয়েছে। এখন অনেকেই দিচ্ছে। যশোর অঞ্চলে এক টাকাও খেলাপি হয়নি। যশোরের মাধ্যমে এর আশেপাশের জেলাগুলোতেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিয়ে আসছি আমরা।
ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও নাসিমুল বাতেন বলেন, আমরা মূলত হোম লোন দিয়ে থাকি। যশোরে আমরা ২০২৩ সালের মধ্যে কার্যক্রম চালু করবো। খুলনায় আমাদের শাখা রয়েছে।
লংকা এলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কান্তি কুমার সাহা বলেন, ২০১৮ সালে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। ব্রাঞ্চ না থাকলেও আমরা কিভাবে সেবা ডিজিটালি পৌছে দিতে পারি সেদিকে নজর দিচ্ছি যেন ঢাকা বসেই উদ্যোক্তারা সুযোগ পান। ফিজিক্যালি এর চেয়ে ডিজিটালি যদি আমরা এগিয়ে নিতে পারি তাহলে আরও বড় পরিসরে সেবা দেয়া যাবে।
ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আবুল আহসান বলেন, যশোরের আশেপাশের জেলাগুলোতে আমরা সেবা সম্প্রসারণ করেছি। যশোরকে শুধু কেন্দ্রতে রাখিনি বরং আশেপাশের জেলাগুলোতে শাখা করেছি ও সেবা দিয়েছি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সাধারণত আসেন না। তাদের কাছে আমরা সেবা পৌছে দেই। তাদের দোরগোড়ায়। অন্যন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ঢাকার বাইরে কার্যক্রম শুরু করলে আমরা অনেক মানুষকে সেবা দিতে পারবে।
আইডিএলসি ফাইনান্স এর ডিএমডি সৈয়দ জাভেদ নূর বলেন, আমাদের সার্ভিস যশোরে ১ যুগ ধরে চলছে। আমাদের চালডালে ৬ % মালিকানা রয়েছে। চালডালের কনসেপ্ট যশোরের হাইটেক পার্কের। যশোরে যে পরিমাণ শিক্ষিত লোক আছে দক্ষ লোক আছে অন্য জায়গায় তা নেই।
এছাড়া ‘দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক খুলনা অফিসের নির্বাহী পরিচালক এস. এম. হাসান রেজা উপস্থিত ছিলেন। প্যানেল আলোচক হিসেবে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এম. জামালউদ্দিন, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও খাজা শাহরিয়ার, ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও নাসিমুল বাতেন, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. কায়সার হামিদ এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আবুল আহসান উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মমিনুল ইসলাম। আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
এর আগে সকাল ১০ টা থেকে মেলার প্রদর্শনী শুরু হয়ে চলবে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত। মেলায় প্রধান সহযোগী ছিলো আইডিএলসি ফাইন্যান্স, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্স। সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিলো মিডাস ফাইন্যান্স লিমিটেড, লংকান এলায়েন্স ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ও আইআইডিএফসি।