জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি বলেছেন, ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। ক্রীড়া, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।’ গত ২৭ মার্চ, রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত মুজিববর্ষ আন্তঃকলেজ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা-২০২১ এর পুরস্কার বিতরণ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন স্পিকার। অনুষ্ঠানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি, মুখ্য আলোচক ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক পাঠদানের পাশাপাশি এসব সহপাঠ কার্যক্রমের ওপর জোর দিচ্ছে, যেটি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পাশাপাশি তাদের মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠতে সাহায্য করবে। মুজিববর্ষ আন্তঃকলেজ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিক্ষার্থী যারা আজ পুরস্কৃত হলে আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। আশা করি ভবিষ্যতে তোমরা ক্রীড়া ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তোমাদের নৈপূণ্যকে তুলে ধরে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করার জন্য সচেষ্ট হবে।’
দেশ সৃষ্টির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে স্পিকার বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে কারাগারে। কিন্তু তিনি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি, মাথা নত করেননি। তাঁর সারাটি জীবন এদেশের নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে কেটেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে একটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। এই ভাষণটি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। কারণ এর মধ্যে জাতির পিতার রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মকা- এবং খেলাধূলা শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষার্থীরা সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবার দীক্ষা পায় এইসব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার মধ্যদিয়ে।’ বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘একটি ভাষণে একটি জাতিরাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এটি বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। মানব ইতিহাসের গত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে এই ভাষণ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ধারণ করেছিলেন।’ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যেন কোনো অপশক্তি রুখে দিতে না পারে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘দেশ অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এদেশের অগ্রযাত্রা যেন কোনো অপশক্তি রুখে দিতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, ১৫ আগস্টের হত্যাকারী অপশিক্তকে রুখে দিতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘তাঁর মতো করে আর কাউকে বাংলাকে ভালোবাসতে দেখিনি। তাঁর মতো করে দরাজ কণ্ঠে লাখো মানুষের সামনে ভাইয়েরা আমার এই শব্দ উচ্চারণ করতে দেখিনি। তাঁর মতো করে মুজিব কোর্ট পরে দাঁড়ালে অমন উঁচু মানের বাঙালি দক্ষিণ এশিয়ায় আর কেউ অনুভব করেনি। তাঁর মতো করে দরাজ কণ্ঠে দাঁড়িয়ে ১৫ আগস্ট হত্যাকারীদের সামনে তোরা কি চাস বলতে পারেনি। তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের আরাধনা। স্বপ্ন পুরুষ। তাঁকে ঘিরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এ প্রতিযোগিতা উপলক্ষ্য মাত্র। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের শিক্ষার্থীরা জাতির পিতাকে জানুক। বঙ্গবন্ধুকে জানুক। শহীদদের আত্মত্যাগকে জানুক। বাঙালি একজন মহানয়কের আহ্বানে লাফিয়ে লাফিয়ে নিজের জীবনকে বিসর্জন দিতে পারে- আগামী প্রজন্মের জন্য এ ইতিহাস পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আর কোথাও নেই বিশ^ব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে বলবে- পদ্মা সেতুর অর্থায়ন না হলে আমরা করবো। অথচ আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি ছিল কিনা আমরা জানতাম না। ওই শক্তির অনুপ্রেরণার উৎস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা। জাতির পিতার সকল আনন্দ, উচ্ছ্বাস নিজের শিশু পুত্রকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রেখে, নিজে কারাগারে থেকে একটি মানচিত্র এঁকেছেন। বাংলাদেশ যার নাম। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তকে ধারণ করেছেন। একটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন এই উপমহাদেশে। যার নজির এই উপমহাদেশে নেই। বিশ্বে বিরল বটে।’
উপাচার্য বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে বিশ্বের বাংলাদেশ হতো অর্থনীতির রোল মডেল। এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল পৃথিবীর শোষিত মানুষের মুক্তির পথনির্দেশনা, অর্থনৈতিক মুক্তির বার্তা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশকে হত্যা করার জন্য। বঙ্গবন্ধুর জাতিসত্ত্বার ভাবনা, বাঙালির মুক্তির ভাবনা, আমরা যে শুষ্ক মরুভূমিতে ছিলাম সেটিকে উর্বরা করেছেন বঙ্গবন্ধু পৃথক জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে। কিন্তু ১৫ আগস্ট সেই উর্বরা ভূমিকে রক্তাক্ত করা হলো। আমাদের দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশে এখনো পাকিস্তান প্রেমি কিছু মানুষ রয়ে গেল। আমাদের আগামী প্রজন্ম সেই জাতিসত্ত্বার স্ফূরণে বেরে উঠুক। আত্মমর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হউক। বিশ্বে দাঁড়িয়ে বলতে পারি আমরা বঙ্গবন্ধুর দেশের মর্যাদাবান নাগরিক।’
মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কিছুতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। অন্যদিকে, পাকিস্তানে সরকার গঠন ও সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এর কোনোটাই তাঁরও কাম্য ছিল না। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল, জনগণকে তাঁর দীর্ঘলালিত স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলা এবং স্বপ্নপূরণে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানানো। কিন্তু এ ব্যাপারে একজন ধীমান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পূর্ব থেকেই তিনি অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে চলেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্স ময়দানের সভামঞ্চে উপস্থিত হয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন, তখন তাঁর চেতনাজুড়ে ছিল বাঙালির হাজার বছরের মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারণ করেন। কেননা তিনি যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা হিসেবে পরিগণিত না হন সে ব্যাপারে পূর্বে থেকেই তিনি সবসময় সতর্কতা অবলম্বন করে আসেন। ৭ ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব হল এই- ভাষণটি নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ৭ ই মার্চের ভাষণই ছিল প্রকৃত অর্থে বাঙালির স্বাধীনতা ঘোষণা। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।’
অনুষ্ঠানে মুজিববর্ষ আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ৯টি ইভেন্টে বিজয়ী ২৭ জন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ছেলে-মেয়েসহ ১২টি ইভেন্টে বিজায়ী ৩৬ জন শিক্ষার্থীকে পুরস্কার হিসেবে সনদ, মেডেল ও আর্থিক সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. নিজামউদ্দিন আহমেদ, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আবদুস সালাম হাওলাদার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেন। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষার্থীবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।