এশিয়ার মানুষের জীবনমানের পরিবর্তনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১৯৫৮ সাল থেকে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। সমাজসেবায় অবদান রাখার জন্য তাহরুন্নেসা আবদুল্লাহ প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ১৯৭৮ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান। ২০২১ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পাচ্ছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী।
কিভাবে এই পুরস্কার প্রবর্তিত হলো : প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে গেরিলা নেতা হিসেবে সাফল্য অর্জন করায় রামোন ডেল ফিরো ম্যাগসেসে জাম্বালেস প্রদেশের সামরিক গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি লিবারেল পার্টি থেকে দুই মেয়াদে জাম্বালেসের কংগ্রেসম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্ট কুইরিনো তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ন্যাশিওনালিস্তা পার্টির পক্ষ হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ম্যাগসেসে। রামোন ডেল ফিরো ম্যাগসেসে ফিলিপাইনের সপ্তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। একজন অটোমোবাইল মেকানিক থেকে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠা এই সাবেক গেরিলা নেতার সম্মানে ফিলিপাইন সরকারের সম্মতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক রকফেলার ব্রাদার্স ফান্ডের ট্রাস্টিরা প্রবর্তন করেন ‘রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার’।
তাহরুন্নেসা আহমেদ আবদুল্লাহ
তাহরুন্নেসা আহমেদ আবদুল্লাহ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নারীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি বয়স্ক নারী শিক্ষা, পুষ্টি এবং নারীদের কৃষিসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সমবায়ের মাধ্যমে আয় বর্ধনের ওপর প্রশিক্ষণ দেন। তিনি নারী সমবায় সমিতি গঠন ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে কাজ করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের নারী-পুরুষের সমতার পথে যাত্রার নতুন দিগন্তে পথ প্রদর্শনের ভূমিকার জন্য তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন।
ফজলে হাসান আবেদ
বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ। সামাজিক উন্নয়নে তার অসামান্য ভূমিকার জন্য তিনি ১৯৮০ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান। ফজলে হাসান আবেদ এ ছাড়াও স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, লিও তলস্তয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার এবং গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার এবং শিক্ষাক্ষেত্রের নোবেল বলে খ্যাত ইয়াইদান পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জের নাইট কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করে। ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডসের রাজা তাকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম বাংলাদেশি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়নে তার ক্ষুদ্রঋণ মডেলের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৪ সালে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
প্রখ্যাত বাংলাদেশি চিকিৎসক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্যবিষয়ক এনজিও ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’র প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত বাংলাদেশের ‘জাতীয় ঔষধনীতি’ ঘোষণার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের নতুন ওষুধনীতি তৈরিতে অবদান, অপ্রয়োজনীয় ওষুধের বিস্তার রোধ এবং সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে রামোন ম্যাগসেসে পান।
মোহাম্মদ ইয়াসিন
১৯৬০ সালে মোহাম্মদ ইয়াসিন সমাজবিজ্ঞানী ড. আখতার হামিদ খানের পরামর্শে গরিব অসহায়দের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মোট ৯ জনের ৯ আনা মূলধন দিয়েই প্রতিষ্ঠা করেন ‘দিদার সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সংগঠনটি’। সেই ৯ আনা থেকে দিদার সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি লি. এখন ১০ কোটিরও বেশি মূলধনসমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সমিতিটির সফলতা দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়লে এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইয়াসিন ১৯৮৮ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান।
এঞ্জেলা গোমেজ
এঞ্জেলা গোমেজ সামাজিক উন্নয়নে নেতৃত্বদানের জন্য ১৯৯৯ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান। গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন, জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ষাটের দশকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে পরিচিতি পান। সে সময়ে সমালোচক এবং সাহিত্য-সম্পাদক হিসাবেও তিনি অবদান রেখেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা পান। সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং সৃজনশীল যোগাযোগকলায় ২০০৪ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান। তরুণদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি এবং তাদের মানবিক মূল্যবোধের উন্মেষে অবদানের জন্য তিনি এ পুরস্কার পান।
মতিউর রহমান
দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান এর আগে ভোরের কাগজ এবং সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ‘সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সৃজনশীল যোগাযোগকলায় ২০০৫ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান। । অ্যাসিড নিক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গণমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকা বিস্তারে তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
এ. এইচ.এম. নোমান খান
সমাজকর্মী এবং বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান এ.এইচ.এম. নোমান খান। তার নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় সিডিডি দেশে ও দেশের বাইরের প্রায় ৩৫০ উন্নয়ন সংগঠনকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে। সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকার জন্য ২০১০ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশী আইনজীবী ও পরিবেশকর্মী। তিনি ২০১২ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান।
ড. ফেরদৌসী কাদরী
ড. ফেরদৌসী কাদরী আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকায় কলেরা, টাইফয়েড ও বিভিন্ন রোগের বিস্তার রোধে তার গবেষণা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে । কলেরার টিকা নিয়ে গবেষণা ও সাশ্রয়ী দামে টিকা সহজলভ্য করে লাখো প্রাণ রক্ষায় কাজ করার কারণে ২০২১ সালের রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পাচ্ছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে রামোন ম্যাগসেসে কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিজ্ঞানের প্রতি ড. ফেরদৌসী কাদরীর অনুরাগ ও নিবেদন এবং মানবসম্পদ ও অবকাঠামো গড়ে তুলতে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সুফল দেবে।