সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম কোনো নথিপত্রের ছবি তুলেছেন কি না, তা আদালতে প্রমাণ হবে। সরকারের নথি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ওটা পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। আবার এমনি এমনি ওই নথি সাংবাদিকের কাছে আসে না। নথি না পেলে যেমন অনেক প্রতিবেদন হয় না, তেমনি ওটা পেলেও যে প্রতিবেদন হবে বিষয়টি এমন নয়। নথির সঙ্গে অনেক কথা ও কাজ মিলে হয় সত্যিকার প্রতিবেদন।
রোজিনা নথি নিয়ে থাকলে জনস্বার্থে তা কতটা গ্রহণযোগ্য এবং আইনের সঙ্গে কতটা সাংঘর্ষিক—এটা নিয়ে তাত্ত্বিক, আইনী ও নৈতিক আলোচনায় সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন। তার কাছে এসব নথি পাওয়া গেছে, না তাকে এসব নথি দেখিয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে- সেই প্রশ্নেরও সুরাহা হবে আদালতে। সোমবারের নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের পর তার বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়েছে, তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। দোষী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি হতে পারে।
আমি কথা বলতে চাই মামলা ও বিচার প্রক্রিয়ার আগের নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। টানা পাঁচ ঘণ্টা একজন নারী সাংবাদিককে নিয়ে যে টানাহেঁচড়া নিজ চোখে দেখেছি, তা কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না। তাকে একটি কক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলেছে তার ওপর, সেখান থেকে শাহবাগ থানায় এনে মধ্যরাতে মামলা দায়ের করা হলো। চিকিৎসা না দিয়ে সারা রাত তাকে থানা হাজতে রাখা হয়। থানা থেকে সকাল ৮টা না বাজতেই কোর্ট হাজতে নেয়া হয়, এরপর সেখান থেকে কাশিমপুর কারাগারে। এসব ঘটনাপ্রবাহ দেখে সংশ্লিষ্টদের সুস্থ মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
সচিবালয়ে একজন সাংবাদিককে আটকে রাখার খবর শোনার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সচিবের কক্ষের সামনে করিডরজুড়ে দেখতে পাই সাংবাদিকদের ভিড়। একান্ত সচিবের কক্ষে রোজিনাকে আটকে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনি দুবার জ্ঞান হারিয়েছেন। সাবেক সহকর্মী হওয়ার সুবাদে জানতাম, রোজিনার শারীরিক নানা সমস্যা রয়েছে। আবার সোমবারই তিনি টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে সচিবালয়ে গেছেন খবরের সন্ধানে।
সচিবালয় থেকে শাহবাগ থানা পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টার নাটকীয় নানা দৃশ্য দেখে নিজের মধ্যে কিছু প্রশ্ন জাগে।
গলা টিপে ধরার ছবি
রোজিনার গলা টিপে ধরছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একজন কর্মকতা বা কর্মচারী। এই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। একজন সরকারি চাকুরে গলা টিপে ধরার শিক্ষাটা কোথায় পেলেন? এই অপরাধ করে তিনি কি বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবেন?
রোজিনা কোনো নথি নিয়ে থাকলে, সেই নথি উদ্ধারে বা যেকোনো কারণে হোক, কেউ তাকে গলা টিপে ধরতে পারে না, তার শরীর তল্লাশি করার এখতিয়ার থাকলেও সেটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি।
আর এসব ছবি কিন্তু সেখানে উপস্থিত কেউ তুলে সাংবাদিকদের দিয়েছেন। ওই ঘটনার সময় রোজিনার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তিনি নির্যাতনের ছবি তোলেননি। আবার ঘটনার সময় সেখানে কোনো সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন না। তাই ছবিটি সাংবাদিকের কোনও সুহৃদ দিয়েছেন।
পুলিশ কর্মকর্তার দাপট
ঘটনার সময় একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি রোজিনার ওপর চড়াও তো হয়েছেন, অন্যান্য নারী সাংবাদিকের ওপরও চড়াও হলেন।
রোজিনা কোনো সন্ত্রাসী বা দাগি আসামি নন। তার বিপদে পড়ার খবর শুনে যারা গেছেন তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক। পুলিশের ওই কর্মকর্তার দাপিয়ে বেড়ানোর ছবি বা ভিডিও দেখলে তার পেশাদারত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবেই। তিনি বাড়তি ফোর্স আনার হুমকি দিয়েছেন, রশি আনার কথা বলেছেন।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে এমন একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। ওনার ক্ষমতা ও দাম্ভিকতা দেখে মনে হচ্ছিল—পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষু্ণ্ন করার জন্য এমন গুটিকয়েক কর্মকর্তাই যথেষ্ট। চোখের সামনে ভেসে আসছিল বেশ কয়েকজন বন্ধু, সুহৃদ ও চেনাজানা পুলিশের মুখ, যাদের অনেককে নিয়ে গর্ব করা যায়।
সচিব ও একান্ত সচিবের দায়িত্বহীনতা
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থানা পুলিশের কাছে যে অভিযোগ দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে—টিকা কেনাকাটা নিয়ে দেশে–বিদেশে নানা তথ্য বা চিঠিপত্র আদান–প্রদান হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নন–ডিসক্লোজার চুক্তি প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। রোজিনা ইসলাম এমন কিছু নথি নিয়েছেন।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় এমন গুরুত্বপূর্ণ নথি কেউ টেবিলের ওপর রেখে যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। এ জীবনে বহু সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করেছি। যে ফাইলটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি তারা আগলে রাখেন। টেবিলের সামনে সাধারণত রাখেন না, লকারে বা ড্রয়ারে রাখেন। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ থেকে সচিবালয়ে আসা-যাওয়া। বাঘা বাঘা আমলাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি তাঁদের কাছ থেকে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলব, যে সচিব বা তার একান্ত সচিব রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ নন-ডিসক্লোজার চুক্তির নথি টেবিলের ওপর রেখে চলে যান, দায়িত্বহীনতার জন্য তাদেরই সাজা প্রাপ্য। কারণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নথি তারা হেফাজত করতে পারেননি।
সাংবাদিকের কাজ কিন্তু গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করা। প্রতিরক্ষা বা পররাষ্ট্র বিষয়ক কিছু তথ্য ছাড়া প্রায় সবই প্রকাশযোগ্য। এগুলো প্রকাশ করায় রাষ্ট্র বা সরকারের ক্ষতি হয় না, ক্ষতি হতে পারে ব্যক্তিবিশেষের।
প্রতিকার চাইতে পারেন রোজিনা
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন নিবারণ আইন আছে, যার মূল কথা হেফাজতে নির্যাতন করা যাবে না। রোজিনার ওপর সচিবালয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা যে নির্যাতন হয়েছে, সেখানে সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন। এসব কর্মকর্তা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত একজন সচিব যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তা।
আবার একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে পুলিশ কনস্টেবল পর্যন্ত ছিলেন। সব মিলিয়ে এক ডজনের বেশি কর্মকর্তা–পুলিশ একজন নারী সাংবাদিকের ওপর চড়াও হলেন। তার গায়ে হাত তোলা হয়েছে, গলা টিপে ধরা হয়েছে। দেহ তল্লাশি করা হয়েছে।
এসব ঘটনা যখন ঘটেছে তখন রোজিনা পুলিশ ও কর্মকর্তাদের হেফাজতে ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে রোজিনা মামলা করতে পারেন।
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের সংজ্ঞায় বলা আছে, নির্যাতন মানে কষ্ট হয় এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং ‘কারও সম্মতিক্রমে অথবা নিজ ক্ষমতাবলে কোনো সরকারি কর্মকর্তা অথবা সরকারি ক্ষমতাবলে-এইরূপ কর্ম সাধনও নির্যাতন হিসেবে গণ্য হইবে।’
একই আইনে বলা হয়েছে, ‘ক্ষতিগ্রস্ত অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অর্থ ঐ ব্যক্তি যাহাকে এই আইনের অধীনে তাহার উপর অথবা তাহার সংশ্লিষ্ট বা উদ্বিগ্ন এমন কারও উপর নির্যাতন করা হইয়াছে।’
তার মানে হচ্ছে, রোজিনার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, এর আইনি প্রতিকার তিনি পেতে পারেন। রোজিনার আইনজীবীও আদালতপ্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি আইনী প্রতিকার চাইতে পারেন।
ব্যক্তিবিশেষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ
একজন সাংবাদিক যদি কোনো নথিপত্র নিয়েও থাকেন এবং তা ধরা পড়লে এত পানি ঘোলা করার প্রয়োজন আদৌ ছিল কী? এখানে দুটি বিষয় ঘটতে পারে; একটি হচ্ছে—কর্মকর্তা ও পুলিশের সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছেন। তারা ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তাদের কাছে ছিল না।
আবার এও হতে পারে—স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিবিশেষের রাগ ও ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তিনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনেক দিন ধরেই ক্ষুব্ধ ছিলেন রোজিনার ওপর। সাম্প্রতিক তিনি বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন করেছেন, যেখানে মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, অনিয়ম ও ব্যর্থতার প্রসঙ্গ রয়েছে।
হতাশার মধ্যে ঐক্য
অনেক হতাশার মধ্যেও আজ সাংবাদিকেরা একযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিং বর্জন করেছেন। যখন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এসে বসলেন, তখনই সব সাংবাদিক একযোগে উঠে গেলেন। সচিবালয় ও স্বাস্থ্য বিটের সাংবাদিকদের অভিনন্দন।
যদিও ভিন্নমত রয়েছে অনুষ্ঠান বর্জনের বিষয়ে। কেউ কেউ বলছেন, সংবাদ সম্মেলন থেকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা উচিত ছিল। সেটি কতটা সম্ভব হতো জানি না। তবে এই প্রতিবাদটুকু অন্তত প্রয়োজন ছিল।
ওপর মহলকে দেখানোর প্রবণতা
রোজিনাকে আটকে রাখার পর সাংবাদিক ও কর্মকর্তাদের মুখে একটিই কথা, বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহল দেখছে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত আসবে। ঘটনার পর রোজিনার সুহৃদ, শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এরপর প্রত্যেকের মধ্যে ধারণা হয়, বিষয়টি তাদের হাতে নেই।
কী অদ্ভুত ব্যাপার! একজন সাংবাদিক সংবাদের তথ্যউপাত্ত জোগাড় করতে গিয়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়লেন। একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা বা সচিবের একান্ত সচিব পর্যায়ে এই বিষয়টি সুরাহা হতে পারত। সেই সিদ্ধান্ত কেন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আসতে হবে?
মনে পড়ে এক–এগারোর সময়ে দলের অনেক নেতাকে তখনকার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এমন ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পুলিশ যাকে, যে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করুক না কেন তাকে (দলের প্রধান শেখ হাসিনা) যেন দেখিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ নির্যাতন–নিপীড়ন ঠেকাতে দলের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা সব দায় কাঁধে নেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখন ছোটখাটো অনেক কাজের ভারও ওনার কাঁধে মন্ত্রী–আমলাদের অনেকেই তুলে দিতে চান। নিজেদের নিরাপদ রাখা, সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষমতা এবং অন্যের ওপর দায় চাপানোর এই প্রবণতা কয়েক বছর ধরে বেশ লক্ষণীয়।
গোপনীয়তার নামে সমালোচনা উন্মুক্ত
একজন সাংবাদিককে নিয়ে তিলকে তাল বানানোর নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ দেখল সারা বিশ্ব। এতে সরকারের লাভ না ক্ষতি হয়েছে, কার ভাবমূর্তি কতটুকু বেড়েছে-একটু ভেবে দেখুন। জাতিসংঘ পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা- এসব বিষয় নিয়ে আগামী দিনগুলোতে সরকারের বিরুদ্ধে যত প্রশ্ন উঠবে, তার বড় দৃষ্টান্ত হবে এই গ্রেপ্তার। সরকার ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের গোপনীয়তা রক্ষার নামে সমালোচনার শতসহস্র মুখ উন্মুক্ত করে দিলেন। এর দায় এবং দায়িত্ব কার খুঁজে দেখা হোক।
সিনিয়র সাংবাদিক
শরিফুজ্জামান পিন্টুর
ফেসবুক থেকে নেওয়া