আবু সুফিয়ান

এবার ফেব্রয়ারি মাসের ১৪ তারিখ ১লা ফাল্গুন। এই দিন ঋতুরাজ বসন্ত আমাদের মুদ্ধ করে তোলে। এই দিনটিতেই আবার পালিত হয় বিশ্ব ভালোবাস দিবস। প্রেমিক প্রেমিকারা বাসন্তী রঙ্গের পোশাক পরে হাতে ফুল নিয়ে ভবিষ্যতের সুন্দর জীবনযাপনের চিন্তায় মগ্ন থাকে। চোখে থাকে সৃষ্টির আনন্দ। হৃদয়ে উদ্বেলিত হয় রঙিন স্বপ্ন। কখনও কখনও দুর থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক। মন তখন এক নান্দনীক সৃষ্টিশীলতায় জেগে উঠে। তবে ভালোবাসা দিবস শুধু প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্যই নয়্। প্রতিটি মানুষ ভালোবাসায় উজ্জিবীত হয়। আপন ভালোবাসায় দিনটিকে বাঙালী নানা ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে । সবাই জেগে উঠতে চায় নতুর সৃষ্টির আনন্দে।
ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসস্ত। সর্বজন প্রচলিত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটি এখন আর খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু এই কবিতার মর্মকথা ভিন্ন ধরনের তাৎপর্য বহন করে। বসন্তের আগমন আমাদের মনে যে রঙ্গের বার্তা দিত তা আমাদের জীবনমুখী করে তুলত, দিত বৈচিত্র্য। তাই আমদের জীবনে ভালবাসা নানা তাৎপর্যে প্রকাশ পেত। আমরা হয়ে উঠতাম কবি, গীতিকার, সাহিত্যিক বা বক্তা। স্কুলে-স্কুলে হতো সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে আবার নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি হতো। মঞ্চায়ত হতো নাটক। আর বসন্তে আমাদের সমৃদ্ধ গ্রামে হতো মেলা। পুতুলনাচ, যাত্রা আর সার্কাস ছিল মেলার অপরিহার্য অংশ। অনুষ্ঠানের শ্রোতারাও উজ্জীবিত হতো এক নতুন মাধুর্যে। অজান্তেই তাদের মনে ভালবাসা অঙ্গুরিত হতো। আর এই ভালবাসা সেবার আদর্শে ছড়িয়ে পড়ত। ফলে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হতো মানবিকতার বন্ধন। এভাবে যুগে যুগে আমরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ে কবিতাকে ধারণ করে এগিযে গেছি আধুনিকতার দিকে।

এখন শহর আর গ্রাম কোথাও ফুলের কমতি নেই। গাছে নয় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে ফুলের। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার ছাদে ছাদে দেয়া যায় বাগান। টাকা দিলেই এখন পাওয়া যায় নানা বর্ণের ফুলের তোড়া। যা অতি সহজে পৌঁছে দেয়া যায় ভালবাসা স্বজনকে। ফলে মানসিকভাবে ফুলের আবিরকে ধারণ করে নিজের ভেতর বৈচিত্র্য তৈরির যে প্রয়াস তা কমে গেছে। এখন সব রেডিমেটের যুগ। এখন যেন যাত্রিকতা আমাদের ওপর ভর করে বসেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা নিজেরা ব্যস্ত থাকি অনেক বেশি।

আমাদের মধ্য থেকে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, ভালবাসা, দেশাত্মবোধকে ধারণ করার বিষয়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে ফেসবুক নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে। বসন্তে আমরা কবিতার বইতো পড়ি না এমনকি দুই লাইন শব্দের ছন্দ মেলানোর জন্য কলম ধরি না। সবকিছু আমরা রেডিমেড পেয়ে যাচ্ছি অনলাইনে বা ফেসবুকে। ফলে আমরা যান্ত্রিকতাকে ধারণ করে বড় হচ্ছি। জন্ম নিচ্ছে দাম্ভিক ভালবাসা। যার পরিমাপ হয় অর্থ দিয়ে। ফলে দেশপ্রেমের বিষয়গুলো আমাদের খুব একটা উদ্বুদ্ধ করে না। চারদিকে লেগে থাকছে অন্তর্দ, সংঘাত আর কোলাহল। কিন্তু বসন্ত আমাদের সৃষ্টিশীল হওয়ার মন্ত্র দিয়েছে চিরকার। বসন্তের আবিরে আমারা মন রাঙ্গাতে পারি না কেন? কেন আমরা কৃত্রিমতাকে ভালবাসি। কেন কবিতার বইয়ের প্রতি আমাদের আকর্ষণ কমছে। কেন আমরা ফেসবুক নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। তা ভাবার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে। ভাষার জন্য আমরা প্রাণ হারিয়েছি। এর জন্য নির্মিত হয়েছিল শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনারের নক্সাতে ছিল নানা রঙের সমাহার।

এই শহীদ মিনারের ২১ ফেব্রয়ারির সময়টি ছিল বসন্তের শুরুতে। রঙের যৌবনের সময়ে। হামিদুর রাহমানের শহীদ মিনারের নক্সায় ছিল মুগ্ধ করা আবির তা শুধু মুগ্ধতা ছড়ায় না সৃষ্টি করে নতুনকে আঁকড়ে ধরার প্রয়াস। সেই অসাধারণ নকশাটি ছিল ঠিক এই ধরনের। এখন আমরা মিনারের যে চারটি স্তম্ভ দেখি প্রতিটির ভেতরে লোহার শিক দেয়া হয়েছে; এটা শিল্পীর মূল পরিকল্পনায় ছিল না। পরিকল্পনায় ছিল স্তম্ভগুলোর মধ্যে থাকবে অজস্র চোখের নক্সা। লেবু, হলুদ আর গাঢ় নীল রঙের স্টেইন্ট গ্লাসের তৈরি হবে চোখগুলো। মিনারের সামনে প্রশস্ত জায়গায় থাকার কথা ছিল মার্বেল পাথর। এই পাথরে স্টেইন্ট গ্লাসের বিভিন্ন রঙ্গিন চোখের আলোকিত প্রতিফলন পড়লে সূর্যের সাতটি রঙের বর্ণালি মেঝেতে সৃষ্টি হতো। মিনারের গায়ে স্টেইন্ট গ্লাসের চোখ থেকে মেঝের মার্বেল পাথরে যে বর্ণালির ছ’টা পড়বে তাতে রঙের একটা কাল্পনিক ঘড়ি অঙ্কন করা যেতে পারে। যেমন আটটা বাজলে বেগুনি রং,বারোটাতে নীল,পাঁচটায় কমলা রং।

এমনি দেখতে দেখতে ঘড়িটার রং পরিচিত হয়ে যেত। ফেব্রয়ারি ও ভাষার বৈচিত্র্যের দিকটির কথা চিন্তা করেই শিল্পী হামিদুর রাহমান এই নানা আভায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা সংগ্রামে যেসব পোস্টাল লেখা হতো তাতেও দেখা যেত রঙের সমাহার। যা তৈরি হতো আন্দোলকারী কর্মীদের নিজের হাতে। তাই রঙের মধ্যে যে শক্তি তা ধারণ করত হৃদয়ের মাধ্যমে। তাই তো ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের প্রতিটি পর্বে হাতে লেখা রঙ্গিন বর্ণমালার পোস্টার আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা রঙের যে ব্যঞ্জনা তা ধারণ করে বড় হয়েছি।

এখন আর দেখা যায় না বিশেষ দিনগুলোতে দেয়াল পত্রিকা হাতে লেখা নানা রং আর বর্ণমালার সমাহার। নেই লিটিল ম্যাগাজিন। হারিয়ে গেছে ঘুড়ি উড়ানোর, পুতুল খেলার সেই দিনগুলো । তবে এখন বেড়ে গেছে বসন্ত উৎসবে বাসন্তি পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানোর উন্মাদনা। আর সেই সঙ্গে সেই রঙ্গিন পোশাকে ছবি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করার প্রবণতা। এখন একটা কঠিন সময় আমরা অতিবাহিত করছি। তাই বাসন্তি রঙের পোশাক শুধু পরলেই হবে না, সেই সঙ্গে এর আভাকেও হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। নিজেকে ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিজের মধ্যে তৈরি করতে হবে মমতাবোধ ও দেশপ্রেম। রং যেন শুধু আমার চোখকে মুগ্ধ না করে মনকেও যেন উজ্জীবিত করে এই বসন্তে এটাই হোক সবার প্রত্যাশা।

লেখা : আবু সুফিয়ান (সাংবাদিক)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে