শহীদ মিনার আমাদের জাতীয় জীনের এক অনন্য প্রতীক। এর চেতনার বিষয়টিকে কখনও অতিক্রম করা যাবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য রক্তদানের মতো ঘটনা একমাত্র এই ভূখ-েই ঘটেছিল। এর পেছনে ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে এবং তাদের জন্য শ্রদ্ধা নিবেদনের কারণে এদেশের মানুষ নির্মাণ করেছিল শহীদ মিনার। ১৯৫২ সালে যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় তা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর আবার ব্যাপকতা পায়। নতুন আঙ্গিকে বৃহৎ পরিসরে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কাজ শুরু হয়। বাস্তবায়নের আগে ১৯৫৮ সালের মার্শাল কারণে তা সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তা গুড়িয়ে দেয়া হয়। দেশ স্বাধীনতার পর নতুনভাবে দেশে-বিদেশে পরিচিত হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি। ভাষা শহীদ দিবস ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুসারে ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বিষয়টি অবশ্যই আমদের স্বাধীন দেশের বাঙালীদের গর্বিত করেছে। আমরা প্রতি বছর যে শহীদ মিনারে ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য যাই তা গোটা বছর থাকে অরক্ষিত ও বিশৃঙ্খল। বিষয়টি অনাকাক্সিক্ষত। হামিদুর রাহমান যে শহীদ মিনার নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন সেটা জানাতে পারলে শহীদ মিনারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা অনেক বেড়ে যাবে। এখন আমরা জেনে নিই হামিদুর রাহমান যে নক্সা করেছিলেন তা কেমন ছিল।

১৯৫৪ সালে এই শহীদ মিনার নির্মাণকাজ শুরু করে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকার। মূল শহীদ মিনারের নক্সা করেছেন হামিদুর রাহমান। যখন শহীদ মিনারের জন্য আগ্রহীদের কাজ থেকে নক্সা আহ্বান করা হয় তখন হামিদুর রহমান ছিলেন লন্ডনে। আর্ট বিষয়ে পড়ার পর তিনি লন্ডনেই অবস্থান করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শহীদ মিনারের নক্সা বাস্তবায়নের জন্য ঢাকায় আসেন এবং কমিটির কাছে নক্সা প্রণয়ন করেন। অনেকে শহীদ মিনারে নক্সা জমা দেয়। বিচারকম-লী হামিদুর রহমানের নক্সাটি নির্বাচিত করেন। এক সাক্ষাতকারে হামিদুর রাহমান বলেছিলেন যখন কেউ আমাদের দেশে আসবে তখন যেন সাবই শহীদ মিনারটিকে দর্শন করতে চায় বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি একটি নক্সা করেন। ভারতে গেলে সাবই যেমন ‘তাজমহল’ দেখতে চায়। আমাদের দেশে এলে সাবই যেন শহীদ মিনার দেখতে চায়। এটাই ছিল হামিদুর রহমানের মূল লক্ষ্য। শিল্প চার্য জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন ‘শহীদ মিনার আমার মায়ে মুখ।

এখানে উল্লেখ করতে হয় যে হামিদুর রাহমান যখন শহীদ মিনারের কাজ শুরু করেন তখন তিনি একে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য তাঁর দীর্ঘ দিনের সহপাঠী ও বন্ধবী ভাস্কর্যশিল্পী নভেরা আহমেদকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে আসেন। তার পর তিনি নভেরাকে শহীর মিনারের মূল বেদীর উপর দুইটি ভাস্কর্য তৈরির জন্য অনুরোধ করেন। এবং তা আংশিক বাস্তবায়ি হয়ছিলো। সে যাই হোকনা কেন আমরাও চাই হামিদুর রহমানের নক্সা অনুসারে যেন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এখানে হামিদুর রহমানের নক্সার বর্ণনা তুলে ধরা হলো।

আজ আমরা যে শহীদ মিনার দেখি তা হামিদুর রহমানের নক্সার একটি খ-িত অংশ মাত্র। হামিদুর রাহমানের মূল নক্সাটি ছিল ঠিক এই ধরনের। এখন আমরা মিনারের যে চারটি স্তম্ভ দেখি প্রতিটির ভেতরে লোহার শিক দেয়া হয়েছে; এটা শিল্পীর মূল পরিকল্পনায় ছিল না। পরিকল্পনায় ছিল স্তম্ভগুলোর মধ্যে থাকবে অজস্র চোখের নক্সা। লেবু, হলুদ আর গাঢ় নীল রঙের স্টেইন্ট গ্লাসের তৈরি হবে চোখগুলো। মিনারের সামনে প্রশস্ত জায়গায় থাকার কথা ছিল মার্বেল পাথর। এই পাথরে স্টেইন্ট গ্লাসের বিভিন্ন রঙ্গিন চোখের আলোকিত প্রতিফলন পড়লে সূর্যের সাতটি রঙের বর্ণালি মেঝেতে সৃষ্টি হতো। পুরো মিনারটির সামনে একটা রেলিং থাকার কথা ছিল।

রেলিংটা আগাগোড়া বর্ণমালা দিয়ে তৈরি হবে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি, তোমায় কি ভুলিতে পারি’ এই কথাটা বার বার রেলিং এ লেখা থাকার কথা ছিল। যে প্রশস্ত জায়গাটি মিনারের সামনে রয়েছে সেখানে বেশ কিছু রক্তমাখা পায়ের ছাপ শহীদের স্মরণে; আর কিছু বিশাল কালো পায়ের ছাপ দানবের প্রতীক হিসেবে থাকার কথা ছিল। আর এই মিনারের পাশেই থাকবে একটা বাংলা সাহিত্যের পাঠাগার, সেই পাঠাগারের দেয়ালে তৈলচিত্র থাকার পরিকল্পনা ছিল। মিনারের সামনে থাকার কথা ছিল সুন্দর এক ঝর্ণা। চোখের মতো অনেকটা দেখতে হতো এর আকৃতি। কালো বিরাট চোখই একটা ঝর্ণা। অনবরত অশ্রুর মতো ঝরবে পানি। সেই পানি আবার জমা থাকবে। মনে হবে মহাকাল ধরে ঝরছে অশ্রুধারা। এই ঝর্ণার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটির প্রায় দেয়াল ঘেঁষে আবার মিনারের মতো একটা উঁচু বেদি উঠে যাবার কথা। যাতে দুই দিকে ঢেউ এর প্রতিক্রিয়া থাকে এবং একটা বিশাল এলাকাজুড়ে শহীদ মিনারের অস্তিত্বটা টের পাওয়া যায়। মিনারের গায়ে স্টেইন্ট গ্লাসের চোখ থেকে মেঝের মার্বেল পাথরে যে বর্ণালীর ছ’টা পড়বে তাতে রঙের একটা কাল্পনিক ঘড়ি অঙ্কন করা যেতে পারে। যেমন- আটটা বাজলে বেগুনি রং, বারোটাতে নীল, পাঁচটায় কমলা রং। এমনি দেখতে দেখতে ঘড়িটার রং পরিচিত হয়ে যেত। আর একটা ঘড়ি থাকার কথা ছিল; উঁচু টাওয়ার ঘড়ি। এর সময়গুলো লেখা হতো বাংলা সংখ্যায়। সময় দেখার কেন্দ্র হিসেবে মিনারের ঘড়ি একটা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যেত। এক হাজার স্কয়ার ফুটের একটি ম্যুরাল পেইন্টিং যেটা মিনারের নিচে জাদুঘরে থাকার কথা, যদি পেইন্টিংটা হতো তাহলে এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম পেইন্টিংগুলোর মধ্যে অন্যতম হতো। ‘যদি পুরো শহীদ মিনারটি শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা অনুসারে তৈরি হতো তাহলে এটা হতো অনন্য অসাধারণ একটি মিনার।’ কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হামিদুর রহমানের নক্সা অনুসারে শহীদ মিনারের কাজ যতটুক এগিয়েছিল তা গুড়িয়ে দেয়।

দেশ স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ইতোমধ্যে ইউনেস্কো মুজিবর্ষ পালনের বিষয়টি জাতি হিসেবে আমাদের আবারও গর্বিত করেছে। তাই দেশের নানা দিক অর্জনের সময় শহীদ মিনারকে হামিদুর রহমানের নক্সার আদলে তৈরির পরিকল্পনার বিষয়টি। আর গোটা বছর যেন বর্তমান শহীদ মিনার অরক্ষিত না থাকে সেই দিকটি আমাদের মনে রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে সরকার শহীদ মিনারকে যথাযথভাবে আরও আকর্ষণীয় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই প্রত্যাশা দেশবাসীর।

লেখক : আবু সুফিয়ান কবির , সংবাদিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে