কিংবদন্তিসুলভ তথ্য, সেকালের সমাজে শিক্ষা খাত ছিল পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত একটি ভুবন। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের প্রতি আমার আগাধ শ্রদ্ধা। পাশাপাশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট পেশায় নিয়োজিত সবার প্রতিও রয়েছে বেশ দুর্বলতা। যাঁরা জাতির যোগ্য নাগরিক তৈরির কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শিক্ষা হলো তাই, যা কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না, বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ আর এরিস্টটলের মতে, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা।’

এই গুরুদায়িত্ব পালনকারী শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘মৃত’ শিক্ষকের নামে বেতন-ভাতা তুলে আত্মসাৎ করেন। কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘মুখরক্ষা’য় নকলে সহায়তা করেন। ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগও প্রায়শই শোনা যায়। এ ধরনের অসংখ্য ‘অনৈতিক ’ কর্মকাণ্ডের খবর লিখতে গিয়ে তখন বারবার হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি। বারবার মনে প্রশ্ন জেগেছে , শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় এসে তারা কেন এ পেশাকে কলঙ্কিত করছেন?

অবশ্য যারা শিক্ষা খাতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অর্থের বিনিময়ে এসব অর্পকর্মের সুযোগ করে দিচ্ছেন, তাদের সন্তানরাতো বিদেশে লেখাপড়া করছে। তাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবনতিতে তাদের কিছুই যায় আসেনা! খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষৎ নষ্ট করে অবৈধ অর্থ কামিয়ে বিদেশে ছেলে- মেয়েদের কাছে পাঠানোই তাদের কাছে মূখ্য। অথচ আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কিংবদন্তিসুলভ তথ্য, সেকালের সমাজে শিক্ষা খাত ছিল পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত একটি ভবন।

শিক্ষাবিটে কাজ করেছি সাংবাদিকতার প্রায় শুরু থেকেই। দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলতে পারি, শিক্ষা সেক্টরে খবরের কোনো অভাব নেই। যেদিকে তাকাই শুধু খবর আর খবর। ইতিবাচক  খবর যেমন আছে, নেতিবাচক সংবাদেরও তেমনই ছড়াছড়ি। অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার খবর এখানে  উৎপাদন হয় প্রতিনিয়ত। এ বিটে কর্মরত রিপোর্টারের সদিচ্ছা থাকলেই এগুলো পাওয়া সম্ভব। রিপোর্টারদের ‘পায়ে পায়ে লক্ষ্মী’ বলে যে কথাটি আমাদের অগ্রজ সাংবাদিকগণ বলেছেন, তার প্রমাণ আমি প্রতিনিয়ত পেয়েছি। এমনকি আমার অন্য সহকর্মীরাও নিশ্চয় পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন।

বিশেষ করে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে এক কদম হেঁটে শিক্ষা ভবনে গেলেই খবরের আর অভাব হয় না। সেখানে প্রায় প্রতিটি ফাইলের পেছনেই অনিয়ম ও দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যায়। এমপিও,বদলি থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজেই ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না। ভবনটিতে এমন কথা প্রচলিত রয়েছে শিক্ষক – কর্মচারীদের মধ্যেই। শিক্ষা ভবনের গেটে পা দিলেই চোখে পড়তো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্ষুধার্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের দুর্ভোগ ও হয়রানির চিত্র। পাশে শিক্ষা প্রকৌকশল অধিদপ্তরের অবকাঠামো নির্মাণেও চলে আরো বড় অনিয়ম ও দুর্নীতি।

একই বিল্ডিংয়ে অবস্থিত দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শন ও নিরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা বাধ্যতামূলক করার দায়িত্বে থাকা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা  অধিদপ্তরও দুর্নীতিতে  পিছিয়ে নেই । সেই প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন রিপোর্ট তৈরির পেছনে রয়েছে  ব্যাপক দুর্নীতি। আর নীতিনির্ধারণী দায়িত্ব থাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির ক্ষত আরো গভীর।

শিক্ষাবিটে কাজ করার সময় খবরের সন্ধানে এসব প্রতিষ্ঠানে পা রেখে প্রায়দিনই এক বা একাধিক রিপোর্টের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ফিরেছি অফিসে। ২০০০ থেকে ২০০৪ সালে আজকের কাগজে আমার অসংখ্য অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থার  খবর গুরুত্বসহকারে  প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষাবিটে না থাকলেও দৈনিক যুগান্তর, ও সমকালেও অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির রিপোর্ট করেছি। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়,স্বনামধন্য সরকারি ও বেসরাকারি  বিশ্ববিদ্যালয়, ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়মের খবর লিখতে হয়েছে।

এছাড়া জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ও শিক্ষা বোর্ডগুলোতেও অনিয়মই নিয়ম বলে মনে করেন  অনেকেই। তাই এ বিটে  কাজ করতে গিয়ে কখনো বিশেষ বা অনুসন্ধানী  রিপোর্টের  অভাব অনুভব করিনি। শিক্ষা সেক্টর ও পাঠ্যপুস্তক  মুদ্রণে অনিয়ম এবং শিক্ষকদের নানা সমস্যা নিয়ে বেশ কয়েকটি সিরিজ রিপোর্টও করেছি। আমি এখনো মনে করি, অন্য কোনো সেক্টরের রিপোর্টের সংকট হলেও শিক্ষা খাতে বিশেষ, স্কুপ ও অনুসন্ধানী রিপোর্টের অভাব নেই। বলা যায়, খবরের খনি হচ্ছে শিক্ষা খাত। শুধু  প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। আমার সময়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কর্মরতদের মধ্যে  দৈনিক ইত্তেফাকের রেজানুর রহমান ভাই, জনকন্ঠের শরীফুজ্জামান  পিন্টু ভাই, প্রথম আলোর আরিফুর রহমান দোলন  ভাই প্রমুখ অনেক  অনিয়ম ও দুর্নীতির রিপোর্ট ও সিরিজ রিপোর্ট করেছেন। আশা করি, তারাও আমার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন যে, এ সেক্টর খবরের খনি।

দীর্ঘদিন ধরে দেশের শিক্ষা খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্য চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারি ও প্রকল্পের টাকা লুটপাটের ক্ষেত্রে এ সেক্টর সব দপ্তরকে ছারিয়ে গেছে। থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে আঞ্চলিক  শিক্ষা অফিস, শিক্ষা  ভবন এমনকি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে ঘুষের দাপট। স্কুলে  ছাত্র ভর্তি, শিক্ষক  নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, শিক্ষকের এমপিওভুক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, জাতীয়করণসহ অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশনের টাকা তুলতে ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, মেরামত, আসবাবপত্র ও শিক্ষা  সরঞ্জাম  কেনাকাটা এবং সরবরাহের প্রতিটি ধাপেই চলে সীমাহীন দুর্নীতি। শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগে চলে সরকারি অর্থের যথেচ্ছ অপচয় আর লুটপাট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটিতে অযোগ্য ও দলীয়করণের মাধ্যমেও দুর্নীতির বীজ বপন করা হয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ দরিদ্র অভিভাবকদের।

২০১৭ সালে শিক্ষা খাতের দুর্নীতি নিয়ে রাষ্ট্রপতি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ২০১৯ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া এক প্রতিবেদনের অন্য দুটি খাতের সঙ্গে শিক্ষা দুর্নীতির অভিযোগ বেড়েছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকাই দুর্নীতি বাড়ার বড়  কারণ। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষা খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জরুরি কর্মসূচি নিতে বলেছেন দুদক। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা খাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে  প্রতিনিয়তই দুদকে আসছে নানা অভিযোগ। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছে দুদক। এতে বেরিয়ে আসছে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো  নির্মাণে দুর্নীতি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষদের অনুপস্থিতি, পরীক্ষা ও ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়, ফেল করা শিক্ষার্থীদের পাশ দেখানো, এমপিওভুক্তকরণ এবং নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি পাওয়া গেছে।

আশা করছি, পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠার আগেই কর্তৃপক্ষের বোধোদয় ঘটবে। তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে ও সঠিক ব্যবস্থা প্রচলনে অভিযান শুরু করবে। সে ক্ষেত্রে শুরু করতে  হবে শিক্ষা খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান। এতে প্রাথমিক গুরুত্বে প্রথম কাজ  হবে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা, কঠোর ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁস  বন্ধ করা, সৃজনশীল  শিক্ষার  পরিবর্তে ব্যাপক পাঠের অনুকূল পাঠ্যক্রম চালু ও একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা  প্রবর্তন করা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যোগ্য শিক্ষক  নিয়োগ , শিক্ষায়তনগুলোর আদর্শভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য পাঠ্যক্রমে আবশ্যিক হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি। এ পাহাড় প্রমাণ পরিবর্তনের কর্মভার কি বর্তমান কর্তৃপক্ষের পক্ষে বহন সম্ভব  হবে?

এ পরিস্থিতিতে আমাদের শিক্ষাবিটের নবীন ও তরুণ  সহকর্মীদের প্রতি অনুরোধ, নিজের স্বার্থে, কর্মরত গণমাধ্যমের স্বার্থে এবং সর্বোপরি দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করুন। সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ভূমিকা রাখুন। আশা করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এগিয়ে যাবেন বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা।

লেখক : লোটন একরাম, প্রধান প্রতিবেদক, দৈনিক সমকাল। কৃতজ্ঞতা : কলম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে