করোনা ভাইরাসের ছোবল বাংলাদেশে আসার পরেই সরকার কার্যকরভাবে তা মোকাবিলা করতে যে কর্মসূচীগুলো গ্রহণ করছে তার মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ উল্লেখ করার মতো। কিন্ত সেটা শিক্ষা খাতে কতটা এলো?

করোনার আঘাতের পর গত বছরের ১৭মার্চ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ । অনলাইন শিক্ষায় আমরা যেতে পেরেছি বেশ পরে। দেশের ৬৫ হাজারের কিছূ বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমেই যেতে পারেনি  । শহরের কিছু মাধ্যমিক স্কুল কলেজ বন্ধেরে তিন থেকে চার মাস পরে সীমিত পরিসরে অনলাইন শিক্ষায় যেতে  পেরেছে।

গেল এক বছরে শিক্ষা খাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী, শিক্ষক এখন শুধু দেহ নিয়েই বেঁচে আছেন । কিন্ত সেই দেহে কোন আনন্দ নেই,  নেই কোন চাহিদা পূরণের সুযোগ । মানসিকভাবে কতো লক্ষ শিশু যে ক্ষতিগ্রস্ত তার কোন হিসাব নেই আমাদের কাছে। কতো শিক্ষক যে বেকার হয়েছেন, আর  কতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে বন্ধ হয়ে গেছে তা নিয়েও কোন আলোচনা নেই । আমি বলছি বেসরকারি শিক্ষকদের কথা । যাদের বেতন হয় শিক্ষার্থীদের বেতন দিয়ে।

বাংলাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি পাশ করা ৯৬ শতাংশ শিশু  ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এটা প্রমাণ করে যে শিক্ষায় অনেক এগিয়ে আছি আমরা । সম্প্রতি সাড়ে ৩০০-এর ওপরে বেসরকারি স্কুলকে সরকারি করা এবং কয়েকটি নতুন সরকারি স্কুল নির্মাণের পরও দেশে মাধ্যমিক স্তরে সরকারি স্কুলের সংখ্যা ৬৮৫ টি। বর্তমানে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬.৩ শতাংশ । আর ৯৩.৬ শতাংশ পড়ছে ১৯ হাজার ৮০২ টি বেসরকারি স্কুলে।  শিক্ষার ৯৫ শতাংশ যেখানে বেসরকারি, সেখানে এমপিওভুক্ত ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ শিক্ষককে সরকারি বেতন দেওয়া ছাড়া টেকসই অর্থ বিনিয়োগ নেই। বরং শতভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর বাড়িভারা ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিচ্ছে সরকার। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে সেরাদের সেরা সব সময়ই এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ।

মাধ্যমিক ও শিক্ষা  অধিদপ্তরের তথ্যমতে দেশে বেসরকারি মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৩৬৩ টি । বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬ হাজার ১০৯ টি। বেসরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা ৭ হাজার ৫৯৮ টি। বর্তমানে এমপিওভুক্ত ৩০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা ৫ লাখ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে ১ কোটি ৬২ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষার্থী । এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা –কর্মচারীদের পেছনে সরকারের প্রতিমাসে খরচ ৮০০ কোটি টাকা । মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যামিক স্তরে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আবার প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক রয়েছে যারা বেসরকারি । অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে হয় তাদের বেতন।

সারা দেশে বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে প্রায় ৪ হাজারে মতো। যারা সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন ছাড়া আর কোন ধরনের সুবিধা গ্রহণ করে না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার । শুধু অনার্স এবং মাষ্টার্স পড়ানো হয় এমন কলেজের সংখ্যা দেড় হাজারের কিছু কম । ২৫ থেকে ৩০ হাজার শিক্ষক রয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানে। শুধু শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে থাকে । নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭ হাজার । এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা ১ লাখের কাছাকাছি । এই প্রতিষ্ঠানগুলো ও শতভাগ বেসরকারি । প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যামিক পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে। সারা দেশে আরো রয়েছে ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন । এগুলো বেশির ভাগই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত । তবে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা অষ্টম শ্রেণি পযন্ত পড়িয়ে থাকে । সারা দেশে ৫ লাখ শিক্ষক রয়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোতে । শিক্ষর্থী সংখ্যা প্রায় ১ কোটি । স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে ৯ হাজার । এ মাদ্রাসাগুলোও বেসরকারিভাবে পরিচালিত । এসব মাদ্রাসায় শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। মূলত প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে থাকে এসব প্রতিষ্ঠান । এই সরকারের সময়ে একবার বাদে প্রতিবারই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে । যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় তার অধিকাংশই চলে যায় বেতন –ভাতা ও অবকাঠামো খাতে ।

৩৭ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৫ লাখ ২০ হাজার ৩৮৮ জন । বেসরকারি ৯০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৯২ জন । আর শিক্ষকের সংখ্যা ১৬  হাজারের কিছু বেশি । দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্জন যেমন অনেক, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনও অনেক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সফলতার কথা বলা হলে সার্টিফিকেট বিক্রির  প্রশ্ন ওঠে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি  কমিশন সনদ বিক্রি উদ্দেশ্যে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগকেই জবাবদিহিতা আওতায় আনতে পেরেছে । তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল কেলেঙ্কারির সংবাদও কি গণমাধ্যমে কম আসে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ সর্বোচ্চ মেধাবীকে গুরুত্ব না দিয়ে ,যখন কম মেধাবীকে নেওয়ার হয় আর ঘটে আন্তহত্যার ঘটনা, সেই  সংবাদও আসে  গণমাধ্যমে । তবে করোনার মধ্যে সব যে বন্দ হয়ে যাচ্ছে এমনও না । প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করে গিয়েছিলেন । রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় নামের এই প্রতিষ্ঠানটির স্লোগান হচ্ছে- জ্ঞান, কর্ম অনুরাগ। করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অনুমোদন দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন । রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আলোকিত মানুষ গড়তেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্ত করোনার থাবার কারণে যখন ছুটি বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন মানবিক কারণে শিক্ষর্থীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করা সম্ভব হয় না । শিক্ষার পূর্নাঙ্গ এই  তথ্য দেওয়ার কারণ হচ্ছে  শিক্ষার বিশাল খাত নিয়ে  সবাইকে একটা সাধারণ ধারণা দেওয়া । করোনা মহামারিতে ভাল নেই বেসরকারি শিক্ষকরা। ভাল নেই শিক্ষা উদ্যেক্তারাও । তথ্য বলছে, গেল এক বছরে দেশে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ১২ হাজার কিন্ডারগার্টেন । এ খাতে প্রোয় ৫০ হাজার শিক্ষক বেকার হয়ে গেছেন। ফুটপাতে ব্যবসা খুলে বসেছেন এমন শিক্ষকের খবর আসে গণমাধ্যমে ।

বিভিন্ন খাতকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের যে প্রণোদনা – এই কর্মসূচিতে শিক্ষা খাতকে যুক্ত করা জরুরি । কারণ শিক্ষাই আমাদের সব । ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের তালিকায় বাংলাদেশ নাম লেখাতে চায় । এই কারণে এখন থেকেই তো উন্নত বিশ্বের দু- একটা উদাহরণ দিতে হবে আমাদের। যদি তা না পারি তাহলে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমরা কী প্রতিযোগিতা করব ? বুকে হাত দিয়ে বলি তো গ্লোবাল মার্কেট আমাদের পক্ষে কী আছে।

করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ের এমন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনার আওতায় আনা না হলে গত ১০ বছরে শিক্ষার যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে তা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে  । ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পাবে । কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ গড়ে তোলা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঝিমিয়ে পড়বে, তখন সংকটে পড়বে শিক্ষা খাত। সাদা চোখে শিক্ষার এই ক্ষতি এক দিনে দেখা না গেলেও কয়েক বছরের মধ্যেই তা টের পাওয়া যাবে । সেটা আমাদের জন্য ভাল হবে না।

লেখক, মোস্তফা মল্লিক

বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে